‘আতিয়া মহল জঙ্গি আস্তানা’
আর্থিক খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা

অন্জন কুমার রায়
করোনা মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব শেষ হতে না হতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তাই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাবে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। যার উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ হ্রাস করা। সেজন্য নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর আট ধাপে নীতি সুদহার বাড়ায়। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। যার ফলে সিলিকন ভ্যালি (সিভি) ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংকের পতন ঘটে। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংকের পতন।

প্রযুক্তি নির্ভর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যতম সিভি ব্যাংক। বিনোদনমূলক কন্টেন্ট ও ডেলিভারি সেবাদাতা হিসেবে প্রযুক্তি নির্ভর স্টার্টআপগুলো প্রচুর মুনাফা করে। বিপুল পরিমাণ মুনাফা করায় স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়। ফলে তাদের বড় পুঁজির প্রয়োজন দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সিভি ব্যাংক প্রযুক্তি নির্ভর স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠে। ঋণের সিংহভাগ অর্থ ব্যাংকটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করেছিল। এ খাতে বিনিয়োগের আস্থা তৈরি হওয়ায় ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে করোনাকালীন সময়ে স্টার্টআপগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে। যার নেতিবাচক প্রভাব প্রযুক্তি সংস্থাগুলির উপর পড়ে। তাই প্রযুক্তি সংস্থাগুলি ঝুঁকিতে পড়ে। ঝুঁকিতে থাকা প্রযুক্তি সংস্থাগুলির প্রতি বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ কমে আসছিল। তাই, বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়াতে মার্কিন ব-ে বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করে। বেশি সুদের কারণে প্রযুক্তি সংস্থার আইপিও’র বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রযুক্তি সংস্থাগুলির তহবিল সংকটে পড়ে। তাই নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি সিভি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা আমানত ভাঙতে শুরু করে। এছাড়াও মূল্যস্ফীতির এই সময়ে গ্রাহকদের চাহিদার কারণে অর্থের প্রয়োজন বাড়ে। ফলে ব্যাংকের আমানতে টান পড়ে। তাই ব্যাংকটি নগদ তহবিল জোগান দিতে সমস্যায় পড়ে।

বিনিয়োগকৃত মার্কিন ব-ে সুদের হার কম থাকায় সিভি ব্যাংকটি ব- বিক্রি করে লোকসানে পতিত হয়। লোকসান পূরণ করা জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২০০ কোটি ডলার তোলার পরিকল্পনা করে। সমস্যা উত্তরনের জন্য শেয়ার বিক্রি শুরু করে ব্যাংকটি। কিšুÍ, শেয়ারের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পায়। খবর ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাংকটির যতটা অর্থ প্রয়োজন ততটা জোগাড় করতে পারছে না। এর পর শেয়ার বিক্রিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্যাংকটির পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। সিভি ব্যাংক বন্ধ হবার কারণে ‘সিগনেচার ব্যাংক’ , ‘ফাস্ট রিপাবলিক’, ‘প্যাকওয়েস্ট ব্যানকর্প’ শেয়ার বেঁচাকেনা স্থগিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যার প্রভাব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যম সারির ব্যাংকগুলোর উপর পড়েছে। আতঙ্ক এতই যে পরিস্থিতি সামাল দিতে ফেডারেল ডিপজিট ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন অনুরোধ করেছে শুধু আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত নয়, সকল প্রকার আমানতেই যেন পরবর্তী দুই বছর পর্যন্ত বীমা দেওয়া হয়।
সিভি ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংক দুটি বন্ধ হবার কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে তারল্য সঙ্কট অন্যতম। ব্যাংক বন্ধ ঘোষণার প্রায় দু’দিন আগে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভূগছে। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে তাদের প্রয়োজন ২২৫ কোটি ডলার। ফলে ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। দুদিন আগে থেকে হাজার হাজার গ্রাহক নিজেদের ব্যাংক হিসাব খালি করে সব টাকা তুলে নিয়ে যায়। ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণার আগেও যেখানে মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। ব্যাংক রানের (ইধহশ জঁহ) ফলে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা অবশিষ্ট ছিল।
ব্রিটাানিকা ডটকমের তথ্যমতে, ১৭৭২ সালে ল-নে ব্যাংকগুলোতে তীব্র তারল্য সঙ্কটের জন্য ব্যাংকে ধস নামে। যার প্রভাবে স্কটল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট ব্যাংককে দেউলিয়া করে দেয়। ফলে, ইউরোপের আর্থিক কেন্দ্র আমস্টারডাম থেকে হামবুর্গ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, জেনেভা, স্টকহোম এবং প্যারিস পর্যন্ত সংকটকে ঘনীভূত করে তোলে। এছাড়াও ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। তখনও একই সময়ে আমানতকারীরা গণহারে তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিতে শুরু করেছিল যার ফলে ব্যাংকে তারল্য সমস্যার সৃষ্টি হয়ে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। লেম্যান ব্রাদার্সের কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। ২০০৮ সালে তারল্য সঙ্কটের জন্যই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।
সিভি গ্রাহক মূলত ছিল প্রযুক্তিগত স্টার্টআপ কোম্পানী। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট খাতে সিংহভাগ বিনিয়োগ করত। যার ফলে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। নির্দিষ্ট খাত দুর্বল হয়ে পড়ায় ব্যাংকটির পতন হয়। ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের বাজার বিষয়ক উপ-অর্থনীতিবিদ জোনাস গোল্টারম্যানের মতে, “ সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক শুধু নির্দিষ্ট কিছু শিল্পে ঋণ দিত বলে সঙ্কটে পড়েছে।”
তবে, অর্থায়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলোর মুনাফার হার এবং ঝুঁকির মাত্রায় নাটকীয় প্রভাব ফেলেছে। মুদ্রার চাহিদা হঠাৎ করে বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুর্বল হয়ে পড়ে। সেজন্য রয়টার্সের বিশ্লেষণে কিছু তথ্য উঠে এসেছে। সে তথ্যমতে, প্রথমেই ফেডারেল রিজার্ভের ক্রমবর্ধমান সুদের কথা বলা হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ধাপে ধাপে সুদের হার বাড়াতে থাকে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চায়নি। সেজন্যই অপ্রত্যাশিত সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ ব্যাংক ধসের অন্যতম কারণ। যা অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহে বাঁধার সৃষ্টি করে। স্বল্পমেয়াদি আমানতকে তারা দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। ব্যাংকের যখন সুদহার বেড়েছে, তখন বন্ডের মূল্য কমেছে। সিভি ব্যাংক যে বিপুল পরিমাণ ব- কিনেছিল তারল্য সঙ্কট মেটাতে সেগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এতে ব্যাংকটির প্রচুর লোকসান হয়। কারণ উচ্চ সুদহার এবং ব-ের দাম বিপরীতমুখী। বলা যেতে পারে, সুদহারের বিপরীতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে না পারায় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে ব্যাংক দুটি। সেক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। এছাড়াও প্রয়োজনীয় আমানতের সংস্থান সম্ভব না হলে ব্যাংক এক ধরণের ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। আবার, ব্যাংকের পর্যাপ্ত তহবিলের চেয়ে দক্ষ তারল্য ব্যবস্থাপনা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ তারল্য ব্যবস্থাপনার অভাবেই অনেক সময় ব্যাংক দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা থাকে। যা থেকে অর্থনৈতিক সঙ্কট গভীর থেকে গভীরতর হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সিভি ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংকের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা।