রমযানুল মুবারক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ৭:০৫:১৩ অপরাহ্ন
![রমযানুল মুবারক রমযানুল মুবারক](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2021/01/sylheterdak-5-768x406.jpg)
শাহ নজরুল ইসলাম :
আজ সোমবার, ১১ রমযান, ১৪৪৪ হিজরি। রমযানের দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের প্রথম দিন। এ দশকে মহান আল্লাহ অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করে দিবেন। আমরাও চাই আমাদের মালিক আমাদের ক্ষমা করুন। হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের নিয়তে রমযানে কিয়ামূল লাইল তথা তারাবীহর নামায পড়বে, তার অতীতের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (সহীহ বুখারী শরীফ)
রমযানের ফযীলত প্রতিদিন ও প্রতিরাতেই বিদ্যমান। রমযানুল মুবারকের একটি অন্যতম আমল হচ্ছে তারাবীহ’র নামায। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমযানের রাতের বিশেষ নামায ঈমানের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সওয়াবের আশায় আদায় করে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ এই হাদীসে বিশেষ নামায অর্থ মুজতাহিদ ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ তারাবীহ’র নামাযকেই বুঝিয়েছেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দিস ইবনে শিহাব যুহরী রহ. উক্ত হাদীস উল্লেখ করে লিখেছেন,‘ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যুগে তারাবীহ’র নামাযের প্রতি আকৃষ্ট করে এর ফযীলত বর্ণনা করেছেন তবে এর জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি।
আবূ বকর সিদ্দীক রা. এর খেলাফতকালেও একই অবস্থা অবলম্বন করা হয়। কারণ তখন লোকজন কোন প্রকারের বাধ্যবাদকতা ছাড়াই অধিক ইবাদত করতো। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এর সময়ে একবার রমযানুল মুবারকে রাতে মসজিদে নববীতে এসে দেখতে পেলেন লোকজন ভিন্ন ভিন্নভাবে তারাবীহ’র নামায পড়ছে। কেউ একাকি আবার কেই জামা‘আত সহকারে নামায আদায় করছেন। ফলে উমর রা. এ ক্ষেত্রে শৃংখলা ও সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। তিনি সকলকে সমবেত করে এক ইমাম সে সময়ের প্রধান কারী উবাই ইবনে কা’ব রা. এর পেছনে নামায পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। আর একদিন এসে মসজিদে দেখতে পেলেন সবাই সমবেতভাবে তাঁর পেছনে নামায আদায় করছেন, তা দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘যদিও এটি একটি নতুন ব্যবস্থা কিন্তু অতি উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যবস্থা মেনে নিলেন।
কেউ কেউ হযরত উমরের এই ব্যবস্থাকে বিদ’আত বলেন, তাদের দলীল যে হযরত উমর নিজেই একে বিদ’আত বলেছেন। এর অনেক জবাব আছে, আর তা হচ্ছে প্রথমত : এখানে হযরত উমর আভিধানিক অর্থে বিদ’আত বলেছেন, শরঈ অর্থে নয়। দ্বিতীয়ত : খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলকে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সুতরাং উমর রা. বিদ’আত বললেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নত বলায় উসূলে হাদীসের বিধান অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্যই এখানে গ্রহণযোগ্য এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরের মুসলিম উম্মার ধারাবাহিক আমলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিৎ নয়। এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত। হারামাইন শরীফাইনসহ বিশ্বব্যাপী বিশ রাকা’আত তারাবীহ‘র আমল চলে আসছে। আর বিষয়টি এমন নয় যে তারাবীহর নামায হযরত উমর শুরু করেছেন বরং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীহ,র নামায জামাতের সাথে পড়েছেন।
কুরআন মাজীদেও এর স্বপক্ষে দলীল রয়েছে। মহান আল্লাহ সূরা নিসার ৫৯ নং আয়তে ইরশাদ করেন, ‘হে মু’মিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী।’ এখানে ‘ঊলুল আমর বলতে মুসলমানদের দুই শ্রেণিকে বুঝায়। ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক যারা কুরআন সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, ২. মুজতাহিদ ও ফকীহগণ। হযরত উমর উপরোক্ত দুই শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সুতরাং তার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা রমযানের রাতে মসজিদে তাশরীফ আনলেন এবং নামায পড়তে থাকলেন। কিছু লোক সে দিন তাঁর সাথে নামাযে শামিল হলেন। পরদিন এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হলো। ফলে দ্বিতীয় দিন অধিক সংখ্যক লোক সমবেত হলেন ঐ দিনও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এসে নামায আদায় করলেন এবং উপস্থিত সকলে তাঁর সাথে একত্রে জামা’আতে নামায আদায় করলেন। এভাবে তৃতীয় রাতও গেল। চতুর্থ রাতে লোক সমাগম এত বেশি হলো যে মসজিদে সংকুলান হলো না। কিন্তু ঐ দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ নামাযের জন্য মসজিদে আসলেন না। ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে আসলেন এবং নামায শেষে সকলকে সম্বোধন করে বললেন, ‘গত রাতে তোমাদের মসজিদে উপস্থিতি সম্পর্কে আমি অজ্ঞাত নই। কিন্তু আমার আশংকা যে, (এ বিশেষ নামাযটির প্রতি এত অধিক আগ্রহ দৃষ্টে তা তোমাদের প্রতি ফরয করে দেয়া হতে পারে। সে অবস্থায় ফরয নামাযে যে সব বিষয়ের প্রতি আবশ্যিকভাবে খেয়াল রাখতে হয়) এ দীর্ঘ নামাযে তোমরা এ গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে অক্ষম হয়ে পড়বে।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় তারাবীহ’র নামাযের অবস্থা এমনই ছিল।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে ইশার জামা’আত ব্যতীত ২০ রাকআত তারাবীহ এবং উইত্র নামায পড়তেন। (সুনানে বয়হাকী ২/৪৯৬, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ২/২৮৬)
উল্লেখ্য, আব্দুুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আপন চাচাত ভাই ছিলেন, অন্যদিকে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মূনা রা. এর ভাগ্নে ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে তাঁর খালার ঘরে রাত কাটাতেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীহ কত রাকা’আত পড়তেন সে ব্যাপারে তাঁর কথাই গ্রহণযোগ্য হবে। আসুন! আমরা গুরুত্ব সহকারে তারাবীহ’র নামায আদায় করি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।