জীবনযুদ্ধে ঘরহীন, ভ‚মিহীন এক দুখিনী হাসনা বেগম
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ৭:৩২:০৮ অপরাহ্ন

আহমাদ সেলিম :
চারপাশে শুধু দালান ঘর, বহুতল ভবন। দালানের ভিড়ে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে বাস করেন একজন দুখিনী মা। সেই মায়ের নাম হাসনা বেগম। তিনি একজন যোদ্ধা। তবে মুক্তিযোদ্ধা নয়। জীবনের সাথে, অভাবের সাথে লড়াই করা একজন অক্লান্ত নারী। সেই মায়ের যুদ্ধগাঁথা জীবন অনেকটা কচুরিপানার মতো। তবে দু:খ পেলে এখন আর আগের মতো অশ্রæপাত হয় না। সবকিছু মেনে নেন অতি সহজে।
১৯৬৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর হাসনা বেগমের জন্ম দোয়ারাবাজার উপজেলার সির্দেরপাড়ায়। সেই হিসেবে বয়স দাঁড়িয়েছে পঞ্চান্ন। ছাতকের দোয়ারাবাজার বাড়ি হলেও কয়েক যুগ ধরে বাস করছেন আখালিয়া নোয়াপাড়ায়। তার ভাষায় ‘চালের কেজি যখন তিন থেকে চার টাকা তখন থেকে এই এলাকায় আছি।’
এই বৃদ্ধার স্বামী নেই। নেই কোনো ছেলে সন্তান। চার মেয়ে নিয়ে তার সংসার। স্বামীর মৃত্যুর পর একে একে চার মেয়েকে বড় করেছেন। বড় মেয়ের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তিনি সিলেটে আসেন, একেবারে শুন্য হাতে। সিলেটে আসার পর স্বামী মারা যান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। স্বামীকে হারিয়ে ছোট হয়ে আসে তার পৃথিবী, বড় হয় সন্তানরা, বাড়ে দু:শ্চিন্তা।
ছোট ছোট চার মেয়ের তিনবেলা খাবার, বাসাভাড়া, তাদের ভরণপোষণ-কঠিন এক ভাগ্য পরীক্ষার সামনে এই বৃদ্ধাকে দাঁড় করায় নিয়তি। খাবার না পেয়ে কত রাত ক্ষুধার যন্ত্রণায় সন্তানরা চিৎকার করে কেঁদেছে, সেই কান্নার শব্দটি অন্যের দেয়ালে যাতে না লাগে তারও চেষ্টা করেছেন। বাঁচার তাগিদে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রদের খাবার রান্না করার পেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। কোনোরকম চলে সংসারের চাকা। এই পেশায় এখনো আছেন। এই পেশা দিয়ে তার মেয়েদের সাধ্য অনুযায়ী বিয়েও দিয়েছেন।
মেয়েদের বিয়ে দিয়েও যুদ্ধ শেষ হয়নি বৃদ্ধার। একদিনের জন্যেও একটু আয়েশ ভাগ্যে জুটেনি তার। চেষ্টা করেছিলেন বহুবার, বিধবা ভাতার সরকারি একটি কার্ডের জন্য, হয়নি। অনেক বার দৌড়েছেন একখন্ড সরকারি ভ‚মির জন্য, একটি বাড়ির জন্য। পাওয়া হয়নি। জীবনের শেষ ডাক যখন আসবে তখন যাতে নিজের একটি বাড়িতে মরতে পারেন-এই স্বপ্ন এখনো দেখেন। মরণের আগ পর্যন্ত দেখতে চান সেই স্বপ্ন।
কিছুই পাওয়া হয়নি জীবনে, তবু তার কোনো দু:খ নেই। এই না পাওয়ার জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও করেননি তিনি। জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে এখন আর কোনো না পাওয়া তাকে বিদীর্ণ করে না। কোনো আক্ষেপও নেই তার। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে, অভিমান হলে কোথাও পালিয়ে যাবেন, তার সাধ্য সেই। সিলেটে আসার পর গ্রামের বাড়িটিও হাতছাড়া হয়, বলা যায় তিনি ঠিকানাবিহীন একজন মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে যখন কথা বলছিলাম তখন বাইরে কান্না না আসলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ এক ভাংচুর, দীর্ঘশ্বাস অনুভব করলাম।
কেমন চলছে রোজার দিনগুলো, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘গত কোরবানীর সময় কোরবানীর মাংস খেয়েছিলাম। আমাদের কিনে খাবার সামর্থ্য নেই। ইফতারের সময় কতকিছু জানে চায়, কিন্তু পাই না। পাতা-লতা রান্না করেই সেহরী করতে হয়। এতে দু:খ নেই। মাংস খেলেও যে দিন যায়, ডাল দিয়ে খেলেও একই দিন যাবে।’
চলার পথে একজন হাসনা বেগমের সাথে পরিচয়। এ রকম বহু হাসনা বেগম রয়েছেন আমাদের সমাজে। তাদের অনেকের খবর রাখা হয় না। অথচ হাসনা বেগমও মানুষ, তিনিও একখন্ড জমি, একটি ঘর পাবার অধিকার রাখেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কিছু কিছু মানুষ এভাবেই অধিকারহীন একটি জীবন কাটিয়ে দেন। তারা চিরকাল থেকে যান বঞ্চিত, অবহেলিত।
আট নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছ জানান, সিটি কর্পোরেশনের ভেতর বিধবা ভাতার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। একই কথা জানিয়েছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক নিবাস চন্দ্র দাশও।