সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য
গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ৮ পরিবারকল্যাণ সহকারী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ৭:৩৮:৫৭ অপরাহ্ন

# মহিতোষ মজুমদার ও মানদা রঞ্জন দাসকে ঘিরে রহস্য
নূর আহমদ:
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের অধীনে দক্ষিণ সুরমা, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা না দিয়েও নিয়োগ পাওয়া সেই ৮ পরিবারকল্যাণ সহকারী এখন ফেরারী। গ্রেফতার এড়াতে তারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অফিসে আসাতো দূরে থাক মোবাইল ফোন বন্ধ করে রয়েছেন আত্মগোপনে। কারণ তারা এখন ফৌজদারী মামলার আসামী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এয়ারপোর্ট থানায় মামলা হয়েছে। মামলা নং-১৯ (২৭/০৩/২০২৩)। এরপর থেকে পুলিশ তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে। অন্যদিকে, জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন সাময়িক বরখাস্ত হলেও তার সহযোগীদের চিহ্নিত করতে মাঠে কাজ করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি শক্তিশালী টিমের সদস্যরা। যারা সিলেটে অবস্থান করে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া, ওসমানীনগরের উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহিতোষ মজুমদার ও দক্ষিণ সুরমার সহকারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মানদা রঞ্জন দাস রয়েছেন সর্বোচ্চ সন্দেহের তালিকায়। অভিযোগ রয়েছে এই দুই কর্মকর্তা জেলা অফিসের সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজসে ভুয়া নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে গত ২৭ মার্চ রাতে ভুয়া নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ পরিবার কল্যাণ সহকারীকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। সিলেট সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবুল মনসুর আসজাদ বাদী হয়ে এয়ারপোর্ট থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১৯(২৭/০৩/২০২৩)। মামলার এজাহার পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিয়োগ পাওয়া ৮ জন পরিবারকল্যাণ সহকারী কেউই স্থানীয় বাসিন্দা নয়। তারা বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে ওসমানীনগরের বুরুঙ্গাবাজার ইউনিয়নের ৩/খ ইউনিটে নিয়োগ পাওয়া ¯িœগ্ধা বিশ্বাস (২৬) আয়া পদের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। তাকে নিয়োগ দেয়া হয় পরিবার কল্যাণ সহকারী হিসেবে। ¯িœগ্ধা বিশ্বাসকে প্রথমে গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। পরে ওসমানীনগরে নিয়োগ দেয়া হয়। ¯িœগ্ধা বিশ্বাস (২৬) মামলার ২নং আসামী। অনলাইনে আবেদিত তথ্য অনুযায়ী তার বাড়ি ওসমানীনগরের মোবারকপুর গ্রামে। বাবার নাম মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস ও মাতা গৌরি বিশ্বাস।
মামলার ১নং আসামী বালাগঞ্জের রিফাতপুর গ্রামের হরিদাস পালের মেয়ে শক্তি রানী পাল। বালাগঞ্জের সদর ইউনিয়নে নিয়োগপ্রাপ্ত এই শক্তি রানী পাল লিখিত ও মৌখিক কোন পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হননি।
৩নং আসামী তাছলিমা আক্তারের বাড়ি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে। তিনি ভুল ঠিকানা দিয়ে ওসমানীনগরের উছমানপুর ইউনিয়নে বিজ্ঞপ্তি বহির্ভূত ইউনিটে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তার বাড়ি শায়েস্তাগঞ্জের উবাহাটা গ্রামে। বাবার নাম মকছুদ মিয়া।
৪নং আসামী পূর্ণিমা নমঃ উছমানপুর ইউনিয়নের ২/ক ইউনিটে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পূর্ণিমা নমঃ মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি, এমনকি তাকে যে ইউনিটে নিয়োগ দেয়া হয়েছে; সেই ইউনিটে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি। পূর্ণিমার বাড়ি জৈন্তাপুর উপজেলার কেন্দ্রী হাওরে। তার বাবার নাম দেবেন্দ্র নমঃ।
৫নং আসামী তাহসিন মাসুমা কচি। যিনি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও ওসমানীনগরের উমরপুর ইউনিয়নে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তার মূল বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি পূর্বপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম আরমান আলী।
৬নং আসামী পলী রানী দাশ বরইকান্দি ইউনিয়নে নিয়োগ পেলেও তার বাড়ি গোয়াইনঘাট উপজেলার মিত্রীমহল গ্রামে। তার বাবার নাম হৃদেশ রঞ্জন দাশ। নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েই তিনি চাকুরি পেয়েছিলেন। ৭নং আসামী মন্টি সরকার (৩২) এর মূল বাড়ি গোয়াইনঘাটের পূর্ব পেকেরখাল গ্রামে। চাকুরি পেয়েছিলেন তেতলী ইউনিয়নে। তিনি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি। ৮নং আসামী পপি দাশ প্রকৃত বাসিন্দা দক্ষিণ সুরমার সিলাম ইউনিয়নের মোহাম্মদপুরের নাথপাড়ায়। তিনি চাকুরি পেয়েছিলেন বরইকান্দি ইউনিয়নে। বিজ্ঞপ্তি বহির্ভূত ইউনিয়নে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন। এমনকি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে এদের একেকজন বিপুল অংকের টাকা দিয়ে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেছিলেন। ধরাপড়ার পর তাদের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। চাকুরি দূরে থাক, এখন তারা ফেরারী হয়ে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সরকারি চাকুরির স্বপ্ন এখন দু:স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
অপরদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন এর বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিনের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক শৃঙ্খলামূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া, তদন্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন যেন বিদেশে পলায়ন করতে না পারেন-এজন্য তাঁর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির নির্দেশ দেয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে। তবে এখন পর্যন্ত ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন এর সহযোগীদের চিহ্নিত করা যায়নি। তাদের চিহ্নিত করতে যুগ্ম সচিব মো: মাহবুব আলমের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি কাজ করছে। দু’একদিনের মধ্যে তাদেরও সনাক্ত করা যাবে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় (১৯৮/১৭/০৬/২০২১)নং স্মারকে। সিলেট জেলার ৪৪টি ইউনিয়নের নির্দিষ্ট ইউনিটে পরিবারকল্যাণ সহকারী পদে ৫৫টি শূন্য পদে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হয়। এরপর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২২ সালের ২৫ নভেম্বর। পরদিন প্রকাশিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে ১৮৬ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। চূড়ান্তভাবে প্রার্থী নির্বাচন (মৌখিক) পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় ৩০ নভেম্বর। এরপর বিভিন্ন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্নের লক্ষ্যে দায়িত্ব দেয়া হয়। দেখা গেছে বালাগঞ্জে তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকা সত্তে¡¡ও সেই উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয় ওসমানীনগরের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মহিতোষ মজুমদারকে। তিনি নিজ উপজেলার পাশাপাশি বালাগঞ্জের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। ভুয়া নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ জনের মধ্যে তার হাত ধরেই ৫ জন যোগদান করেন।
মহিতোষ মজুমদার দৈনিক সিলেটের ডাক এর সাথে আলাপকালে জানিয়েছিলেন তিনি জেলা অফিসের মেইলে নিয়োগ আদেশ পেয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগদানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে জুনাকি দাস নামে যিনি মেইল অপারেট করেন তিনি মহিতোষ মজুমদারের আপন ভাগ্নি। এছাড়া সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটি তদন্ত কাজ শুরুর পর ওসমানীনগর পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারীকে ডাকে। এই খবর পেয়ে মহিতোষ নিজেই দ্রæত বিমানে ঢাকায় অধিদপ্তরে ছুটে যান। তদন্ত কমিটি সিলেটে এসে তাকে না পাওয়ায় আরো সন্দেহ বাড়ে। এরপর তাকে অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকিতে বিকেলের ফ্লাইটে সিলেটে পাঠিয়ে তদন্ত কমিটির মুখোমুখি করা হয়।
একইভাবে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠে। তার উপজেলায় ভুয়া ৩ পরিবার পরিকল্পনা সহকারীর যোগদানের বিষয়টিও এই সূত্রে গাঁথা বলে জানিয়েছে সূত্র। আরো জানা গেছে, বিভিন্ন দপ্তরে এসব কর্মকর্তার একে অন্যের আত্মীয় কর্মরত রয়েছেন। ফলে জেলা অফিসে আত্মীয়তার সূত্রধরে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ফলে অন্যদের সাথে ওসমানীনগর ও দক্ষিণ সুরমা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্দেহের চোখে রেখেছে তদন্ত কমিটি।
এ ব্যাপারে এয়ারপোর্ট থানার ওসি মইন উদ্দিন জানান, একজন সরকারি কর্মকর্তা বাদী হয়ে ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। বিষয়টি তদন্তনাধীন রয়েছে। পুলিশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো: কুতুব উদ্দিন জানান, জনবল নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আমরা পেয়েছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৮জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। এখনো তদন্ত কমিটি কাজ করছে, জেলা অফিসের অভ্যন্তরে কারা জড়িত থাকতে পারে সেটি তদন্ত প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
উল্লেখ্য, গত ২২ মার্চ ‘লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা না দিয়েও নিয়োগ পেলেন ৯ পরিবারকল্যাণ সহকারী’ শিরোনামে-দৈনিক সিলেটের ডাক-এ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। রিপোর্ট প্রকাশের পর সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়। এরপর থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।