ইসির তফসিল ঘোষণা
সিলেট সিটি নির্বাচন ২১ জুন ভোট হবে ইভিএমে
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ৭:৪৭:২৮ অপরাহ্ন
ইসির নিজস্ব ট্যাব দ্বারা মনিটরিং নৌকা পেতে ৯ প্রার্থী মাঠে আরিফকে ঘিরে নানা আলোচনা
কাউসার চৌধুরী :
সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তফসিল অনুযায়ী সিসিক’র ভোট হবে আগামী ২১ জুন বুধবার। এবার ভোট গ্রহণ করা হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতিতে। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৩ মে মঙ্গলবার। ২৫ মে বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র বাছাই এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১ জুন বৃহস্পতিবার।
গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত ইসির ১৭তম সভায় সিসিকসহ দেশের ৫ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় নির্বাচন কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানান, দেশের পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের ভোটের তারিখ চ‚ড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। এসব নির্বাচনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরাও থাকছে। ঘোষিত তারিখে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। সব সিটি নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। ভোটের আপডেট ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা ট্যাবের মাধ্যমে কমিশনকে জানাবেন।
এদিকে, তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে । বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ৯ জন প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। ইসির তফসিল ঘোষণার একদিন আগে সিসিকের বর্তমান মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী লন্ডনে ছুটে গেছেন। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল পেতে দু’জনের নাম আলোচিত হচ্ছে। এছাড়াও মাঠে আছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও। বসে নেই কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। পাড়া-মহল্লায় তাদের তৎপরতা সমানতালে চলছে। আসন্ন নির্বাচন হবে সিসিকের ৫ম নির্বাচন।
জানা গেছে, সিসিক নির্বাচনে নৌকার মাঝি হতে আওয়ামী লীগের ৯ নেতা সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত রাখছেন। সিলেট নগরীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান সড়ক ও মোড়ে মোড়ে এ সকল নেতাদের ছবি সম্বলিত সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড সাটানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব রয়েছেন এ সকল মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করছেন। জুমার দিনে মসজিদে মসজিদে গিয়ে মুসল্লীদের দোয়া চাইছেন। ছুটে যাচ্ছেন মন্দিরেও।
নৌকার মাঝি হতে ঘোষণা দিয়ে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক কে›ন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল ও যুগ্ম সম্পাদক সিসিক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, সাবেক মেয়র প্রয়াত বদর উদ্দিন আহমদ কামরান পুত্র আরমান আহমদ শিপলু, সিসিকের সাবেক কাউন্সিলর ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট মহানগর ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালিক ও আওয়ামী লীগ নেতা প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী।
২০০২ সালে সিসিক প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা চার বার দলের প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দি¦তা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ২০২০ সালের ১৫ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কামরান ইন্তেকাল করেন। জনপ্রিয় এই নেতার মৃত্যুর বছর খানেক পর সিসিকের মেয়র পদে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী বেশ কয়েকজনকে মাঠে নামতে দেখা যায়। সিলেট নগরীতে যখন এসব মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সরব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন এরই মধ্যে গেল ২২ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ঘটা করে সিলেটে এসে নিজের মনোনয়ন প্রত্যাশার ঘোষণা দেন। অবশ্য, এখনো দলীয় নীতি নির্ধারনী ফোরাম সিলেট সিটি কর্পোরেশনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে কারও নাম ঘোষণা করেনি। তবে, নৌকা পেতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রে কেউ কেউ জোর তদ্বির করছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, হারানো মেয়র পদ পুনরুদ্ধারে এবার শক্তিশালী প্রার্থী দেবে আওয়ামী লীগ। সিলেট নগরীতে দেয়া সরকারের বিপুল পরিমাণের উন্নয়ন বরাদ্দের বিষয়টিও ভোটারদের মাঝে তুলে ধরা হবে।
এদিকে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এই হিসেবে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আসন্ন সিসিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। তবে, কর্মী-সমর্থকদের চাপে শেষ পর্যন্ত আরিফ মেয়র পদে প্রার্থী হবেন বলেও নগরীতে গুঞ্জন রয়েছে। গেল পরশু তিনি লন্ডনে ছুটে গেছেন। এর বাইরে মেয়র পদে বিএনপির আর কারো নাম শোনা যাচ্ছে না।
জাতীয় পার্টির লাঙ্গল পেতে প্রথমে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান চৌধুরীর নানা শোনা যায়। তার ছবি সম্বলিত সাইনবোর্ড-ব্যানারও সাটানো হয়। এরপর ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বাবুলের নামেও সাইনবোর্ড-ব্যানার সাটানো হয়েছে। কে হচ্ছেন লাঙ্গলের প্রার্থী তা এখনো নিশ্চিত নয় বলে জানা গেছে।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। হাফিজ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে (এলএলবি) হাতপাখার প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে সংগঠনটি ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে।
এছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র হিসেবে আরও প্রার্থী মাঠে নামবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
আগে কেবল সিলেট নগরীর ২৭ ওয়ার্ডে ভোটের লড়াই চললেও এবার সীমানা বর্ধিত হওয়ায় পরিধি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ওয়ার্ড সংখ্যা এখন ৪২টি। নতুন-পুরাতন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীরা আগেভাগে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটে যান। তফসিল ঘোষণার ফলে সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সিসিক প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৯ বছর পর ২০২১ সালে সিসিককে বর্ধিত করা হয়। বর্তমানে সিসিকের মোট আয়তন ৫৯ দশমিক ৫০ বর্গ কিলোমিটার। নতুন করে ১৫টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড বেড়েছে। নতুন ও পুরাতনসহ সিসিকের মোট সাধারণ ওয়ার্ড ৪২টি। পুরনো ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডসহ বর্তমানে মোট সংরক্ষিত ওয়ার্ড হচ্ছে ১৪টি।
১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেট পৌরসভা প্রতিষ্ঠা হয়। পৌরসভা প্রতিষ্ঠার টানা ১২৪ বছর পরে ২০০২ সালের ২৮ জুলাই প্রতিষ্ঠা হয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সিসিকের ৪র্থ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। ধানের শীষে আরিফের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯২ হাজার ৫৯৩ আর কামরান নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন ৮৬ হাজার ৩৯৭ ভোট। এরপর ৭ নভেম্বর সিসিকের নির্বাচিত পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হয় সিসিকের তৃতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচনে প্রথম বার অংশ গ্রহণ করেই আরিফুল হক চৌধুরী ৩৫ হাজার ১০০ ভোটের ব্যবধানে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করেছিলেন। নির্বাচনে নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপি নেতা আরিফ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭ হাজার ৩৩০ ভোট আর আওয়ামী লীগের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছিলেন ৭২ হাজার ২৩০ ভোট।
ওয়ান-ইলেভেনের পট-পরিবর্তনে তত্ত¡াবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালে সিসিকের দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের আগেই গ্রেফতার হন কামরান। কারাগারে বন্দী কামরানকেই মেয়র পদে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। কারাবন্দী কামরান আনারস প্রতীকে এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে আ ফ ম কামালকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন।
২০০৩ সালে সিসিকের প্রথম নির্বাচনেও কামরান বাই সাইকেল প্রতীকে বিজয়ী হয়েছিলেন। বিএনপির এম এ হক মাছ প্রতীকে কামরানের কাছে পরাজিত হন।