প্রসঙ্গ : বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ব্যয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ৮:৫৮:২২ অপরাহ্ন
মো. ইউসুফ আলী
কনকনে শীতের সকালে (২৪ জানুয়ারী ’২৩) মেয়ের ভর্তি উপলক্ষে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছিলাম। শিশির ভেজা সকালে মিষ্টি রোদে সারি সারি চেয়ারে স্যুট কোট পরা ভদ্র মহোদয়গণ বসে ছেলে মেয়েদের সাফল্যের ফিরিস্তি গাইছেন। আগত ভদ্র মহোদয়গণের মধ্যে এক কোণায় লুঙ্গি পরিহিত মলিন চেহারায় পঞ্চাশ উর্ধ্ব একজন বসে আছেন। এতো জন লোকের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যতিক্রম হওয়ায় উনার সাথে আলাপ করার কৌতুহল জাগল। বেচারী এসেছেন সুদূর রাঙ্গামাটি থেকে ছেলেকে ভর্তি করাতে। আলাপ প্রসঙ্গে ভর্তি খরচাদি উঠলে বেচারী অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে যান। নিজের মেয়ে ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায় বিশাল খরচের যোগান দিতে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছিলাম। ভর্তির আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ভর্তি হওয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর কমছে কম অর্ধ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। ভর্তি ব্যয়ের হিসাবটা না দিলে আলোচনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সে জন্য খাতওয়ারী হিসাবটা উল্লেখ করছি।
মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, গুচ্ছ সাধারণ, গুচ্ছ কৃষি, গুচ্ছ ইঞ্জিনিয়ারিং, গুচ্ছের বাইরে ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এই নয় ক্যাটাগরিতে আবেদন করতে ১০০০০/- ১২০০০/- (দশ হাজার থেকে বার হাজার) টাকা লাগছে। যারা সব ক্যাটাগরিতে আবেদন করেছে এবং ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের যাতায়াত বাবদ কম হলেও ২০০০০/- (বিশ হাজার) টাকা লাগছে। এরপর ভর্তি নিশ্চায়নে ৫০০০/- (পাঁচ হাজার), চ‚ড়ান্ত ভর্তি ফি ১৫০০০/- ২০০০০/- (পনের থেকে বিশ হাজার), তদসঙ্গে যাতায়াত ৩০০০/- ৫০০০/- (তিন থেকে পাঁচ হাজার) টাকা। হলে সীটের জন্য আরও ৬০০০/- ১০০০০/- (ছয় থেকে দশ হাজার) সর্বমোট প্রায় ৬০০০০/- (ষাট হাজার) টাকা। এ বিশাল ব্যয় বহন করার সক্ষমতা কতজন অভিভাবকের আছে! আমরা বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে সে হিসাব দিচ্ছি কিন্তু বিপুল সংখ্যকের মধ্যে কতজন দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী অর্থের অভাবে ঝরে পড়ছে তা জানা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দু-চার জন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে সমাজের বিত্তবানরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
দরিদ্র, নি¤œবিত্ত অভিভাবকের মেধাবী ছেলে মেয়েরা অনেক কষ্ট করে দু-একটাতে আবেদন করে ভর্তি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে সামর্থবান অভিভাবকের ছেলে-মেয়েরা সব গুলোতে অংশ গ্রহণ করে কম মেধাবী হলেও জিতে যাচ্ছে। গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ধারাবাহিক মেরিট লিষ্ট প্রকাশ করার পাশপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটাছুটি করতে হয়েছে। এখানেও দরিদ্র শিক্ষার্থীরা ছিটকে পড়েছে। এছাড়া করোনা কালিন সামর্থবান অভিভাবক ছেলে মেয়ের অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম সচল থাকলেও ডিভাইজের অভাবে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষাকার্যক্রম থেকে বঞ্চিত ছিল। করোনা মহামারি কারণে নি¤œবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ থাকার ধকল সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তারই সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে শিক্ষার সকল ব্যয় অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ঝরে পড়ছে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা।
গত ২৩ জানুয়ারী’২৩ তারিখে দৈনিক সিলেটের ডাকে সম্পাদকীয় কলামে লিখেছে, ‘করোনা মহামারির আঘাতে আয় কমেছে মানুষের। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ের। প্রতিক‚লতার মধ্যেও যারা এখনো ঝরে পড়েনি, তাদের জন্য এবার দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে খাতা-কলমসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি’। করোনায় শিক্ষায় অপূরনীয় ক্ষতির পাশাপাশি বৈষম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৈষম্য উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় আরও বেশি পেয়েছে। করোনা কালিন স্কুল, কলেজের ক্লাস বন্ধ থাকলেও অনলাইনে কোচিং ক্লাস ও বাসায় টিউটর রেখে সামর্থবান অভিভাবকেরা ছেলেমেয়ের শিক্ষাকার্যক্রম সচল রেখেছে। উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির জন্য অনলাইনে পুরোদমে কোচিং করেছে। এসব সুযোগ সুবিধা থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেও ভর্তি পরীক্ষায় বিশাল ব্যয়ের কারণে সব গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারে নাই। বলতে গেলে শিক্ষা বাণিজ্যকরণ দিনকে দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। নি¤œবিত্ত, দরিদ্র শ্রেণির শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষার দ্বার বন্ধ হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে আতিউরদের মতো ব্যক্তিদের হয়তো উচ্চ শিক্ষায় খোঁজে পাওয়া যাবে না।
তথ্য প্রযুক্তিতে দেশ অভাবনীয় অগ্রতি অর্জন করেছে। এই সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি,সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো সম্ভব।এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর আর্থিক মোহই প্রধান অন্তরায়! কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র করছে। জনস্বার্থে সরকারকে ভর্তি পরীক্ষা নামে বাণিজ্য বন্ধ করা এবং শিক্ষা ব্যয় কমানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রত্যাশা রইল।
লেখক : শিক্ষক।