শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১২:২৬:৩৮ অপরাহ্ন
![শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য শিক্ষায় ব্যাপক বৈষম্য](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/03/dak-po-sompadoki.jpg)
পাপড়ি রানী রায় :
সমাজে নৈতিক অবক্ষয় এখন ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে নৈতিকতার লেশমাত্র অবশিষ্ট আছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে নৈতিকতার অভাব। কারণ, রাজনীতি সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সমানভাবে প্রভাবিত করে। এর পরে সম্ভবত শিক্ষার ভূমিকা। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিকবোধের যে অভাব দেখা যাচ্ছে; তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সন্ত্রাস চাঁদাবাজি ও বিশৃঙ্খলা। আগে ছাত্রীদের মধ্যে এমন আচরণ খুব একটা দেখা যেত না। এখন দেখা যাচ্ছে সরকারি দলের ছাত্রীরা কিছু দুষ্কর্মে ছাত্রদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
একটি জাতীয় দৈনিকে গত ২৭-০২-২৩ সোমবার এ নিয়ে প্রধান খবর করেছে, ছাত্রীর আর্তনাদে উল্লাস করে নির্যাতনকারীরা। পানি চাইলে ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়। চিৎকার করলে গামছা ঢুকিয়ে দেয়া হয় মুখে। এ বর্বরতাকে আবার ভিডিও ধারণ করেন তারা। এটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলপরী নামে নির্যাতিত ছাত্রীর ঘটনা। এমন কোনো না কোনো ঘটনা এখন প্রতিদিন ঘটছে। এ অবস্থায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা কেমন চলছে সেটি এক প্রশ্ন। অন্য একটি জাতীয় দৈনিকের এক শীর্ষ সংবাদে সারা দেশে কলেজ শিক্ষার অবস্থা কেমন এর একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, শিক্ষার প্রতি কোনো নজরদারি কর্তৃপক্ষের নেই। এ দেশের শিক্ষার বিকাশ ঘটুক এমন হিতকর চিন্তাকারী কেউ অবশিষ্ট নেই। নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায়, আমাদের শিক্ষা সামনের দিকে যাওয়ার বদলে দ্রুত পেছনের দিকে হাঁটছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা কেমন চলছে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
দেখা যাচ্ছে, সরকারি ৩০০টিসহ মোট ৮৮০টি কলেজে স্নাতক কোর্স চালু রয়েছে। কলেজগুলোতে ২৯ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। বেশির ভাগ কলেজে নেই শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার। অবকাঠামোর কথা চিন্তা না করে শুধু ব্যবসায়িক চিন্তা ও রাজনৈতিক প্রণোদনায় বেশির ভাগ কলেজে উচ্চশিক্ষার অনুমতি নেয়া হয়েছে। পত্রিকাটি শিক্ষকস্বল্পতার চিত্র তুলে ধরে সিলেট এমসি কলেজের উদাহরণ দিয়েছে। এ কলেজে ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ১২০ জন শিক্ষক রয়েছেন। ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ৩০ হাজারের বেশি ছাত্রের বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন আরো কম মাত্র ২২০ জন। এমসি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রিতে পরিসংখ্যান পড়ার সুযোগ আছে। পরিসংখ্যানে স্নাতক চালু হয় ২০০৪ সালে। ২০১১ সালে যুক্ত হয় স্নাতকোত্তর। এ বিভাগে শিক্ষকের পদ আছে মাত্র চারটি। তাও গত আট মাস ধরে কলেজটিতে এ বিভাগে শিক্ষকের তিনটি পদ শূন্য। অথচ স্নাতক প্রথম বর্ষে এ বিভাগে ১৩০ আসন রয়েছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে এখন রয়েছে ৩৫০ শিক্ষার্থী। তার সাথে রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রির পরিসংখ্যান নেয়া শিক্ষার্থীও। এমসি কলেজ সিলেট অঞ্চলের সেরা কলেজ। প্রকৃতপক্ষে সারা দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চশিক্ষার চিত্র কমবেশি এমন। উচ্চশিক্ষার সাথে বাধ্যতামূলক গবেষণা ও প্রকাশনা। এ জন্য ২০২১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ ছিল পাঁচ কোটি টাকা। তবে জানা যায়নি এ টাকা দিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কিনা। শিক্ষা খাতে দুর্নীতির বড় একটি অংশ নানা নামে বরাদ্দ হওয়া অর্থ নিয়ে অনিয়ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আছে দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৪১ জন। মোট শিক্ষার্থীর এটি ৯ শতাংশ হলেও তারা নামমাত্র ল্যাবরেটরি সুবিধা পান। তাহলে এ ধরনের বিজ্ঞান পড়াশোনার কোনো কার্যকারিতা থাকার কথা নয়। উচ্চ শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। এরা সমাজের দরিদ্র ও অধিকারবঞ্চিত শ্রেণী থেকে আসেন। দেখা যাচ্ছে, এদের পেছনে সরকারের বায়ও একেবারে কম।
২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের পেছনে ব্যয় হয় এক লাখ ৮৫ হাজার, বুয়েটের একজনের পেছনে ব্যয় হয় দুই লাখ ৯৮ হাজার টাকা। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় মাত্র ৭৪৩ টাকা। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় চরম পরিকল্পনাহীনতা বিশৃঙ্খলা ও সরকারি ছাত্রসংগঠনের আধিপত্যের মতো বৈষম্যও সীমাহীন। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন। উচ্চশিক্ষার এমন দুর্বল অবস্থা অন্য কোনো দেশে সম্ভবত এতটা পাওয়া যাবে না। আসলে জাতির বৃহত্তর অংশকে আমরা অবহেলা করছি। এ হতাশাজনক অবস্থার পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগ আয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে নেই।
লেখক : শিক্ষক-কলামিস্ট।