পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে বৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যেও ঘাপলা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ৬:১৫:১৭ অপরাহ্ন
মামলায় আসামী হচ্ছেন ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন এক কর্মচারীর সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গানো নিয়ে রহস্য
নূর আহমদ :
জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের থলের বিড়াল ক্রমশ বেরিয়ে আসছে। এবার ফৌজদারী মামলায় এজাহারভুক্ত (নথিভুক্ত) হচ্ছেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিন। তাকে ফৌজদারী মামলায় আসামী করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা এড়িয়ে গিয়েছিলেন মামলার বাদী। তবে, মামলার বাদী দাবি করেছেন, মামলা দায়েরের পরদিন সচিবালয় থেকে নির্দেশনা পেয়েছেন। এরপর থানা পুলিশকে নির্দেশনার কপি দিয়ে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিনকে আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানানো হয়েছে পুলিশকে। অন্যদিকে শুধু ৮ জনই নয়, জেলা প্রশাসকের সুপারিশকৃত ৫১ জনের মধ্যেও আপত্তি থাকা সত্ত্বেও দুইজনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। একই সাথে এই নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসছে। এ নিয়ে সিলেট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সংশ্লিষ্টদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে গত ২৭ মার্চ রাতে ভুয়া নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ পরিবার কল্যাণ সহকারীকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। সিলেট সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবুল মনসুর আসজাদ বাদী হয়ে এয়ারপোর্ট থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১৯(২৭/০৩/২০২৩)। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের চারটি ব্যবস্থামূলক স্মারকের একটি স্মারকে (৫৯.০০.০০০০.১১০.৯৯.০০২.২৩-২২১) পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সিলেটের জেলা প্রশাসক তথা নিয়োগ কমিটির সভাপতিকে জনবল নিয়োগ ও বাছাই কমিটির সুপারিশ বহির্ভূতভাবে নিয়োগকৃত ৮ জন ব্যক্তির নিয়োগপত্র বাতিলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বর্ণিত কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়েরের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু মামলা হলেও এজাহারে আসামী করা হয়নি-জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিনকে।
মামলার বাদী সিলেট সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবুল মনসুর আসজাদ দাবি করেন, তারা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরের নির্দেশনার আলোকে ২৭ মার্চ রাতে মামলা দায়ের করেন। তবে সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপনটি তারা পরদিন ২৮ মার্চ পেয়েছেন। যার জন্য সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিনের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি। তবে পরদিন সচিবালয়ের নির্দেশনা সম্বলিত প্রজ্ঞাপন এয়ারপোর্ট থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
লাকী চন্দ ও পলি সাহার নিয়োগ বিতর্ক: চূড়ান্ত পরীক্ষা দূরে থাক, লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও অনেকেই চাকুরি পেয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ জন দক্ষিণ সুরমা, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মরত ছিলেন। চাকুরি তো দূরে থাক; এখন তারা ফৌজদারী মামলার ফেরারী আসামী। তখন পরিবারকল্যাণ সহকারীর ৫৫ পদের বিপরীতে ৫১ জনকে উপযুক্ত হিসেবে চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সিলেটের সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট আরো ৮ জনকে অতিরিক্ত নিয়োগ দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছিলো, ওই ৫১ জনকেই হয়তো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু, ঘটেছে এর উল্টো। দেখা গেছে, দুই জন স্থানীয় বাসিন্দা না হয়েও নিয়োগ পেয়েছেন। আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে, যারাই তাদের স্থানীয় ঠিকানা সঠিক নয় বলে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন; তাদের হাত ধরেই পুনরায় তারাই নিয়োগ পেয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গোয়াইনঘাটের নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের ৩/খ ইউনিটে নিয়োগ পান লাকী চন্দ। তিনি স্থানীয় ঠিকানা চালিতাবাড়ী পরিচয় দিয়ে নিয়োগ পান। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা নয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো: বদরুল ইসলাম তার উপজেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত ৫ জনের তদন্ত করে লাকী চন্দের ঠিকানা সঠিক নয় বলে প্রতিবেদন দেন। কিন্তু, পরবর্তীতে তার হাত ধরেই লাকী চন্দ পরিবারকল্যাণ সহকারী হিসেবে যোগদান করেন এবং তিনি কর্মরত রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, শিবেন্দ্র নামের এক কর্মচারীর মাধ্যমে জেলা অফিসকে ‘ম্যানেজ’ করে যোগদানের ব্যবস্থা করে নেন লাকী চন্দ। অবশ্য এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো: বদরুল ইসলাম দাবি করেন, জেলা কার্যালয়ের আদেশে তিনি যোগদানের সুযোগ দিতে বাধ্য হন।
অপরদিকে একই ঘটনা ঘটেছে গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ৩/খ ইউনিটে। পলি সাহা এই ইউনিটের পূর্বপাড় গ্রামের বাসিন্দা উল্লেখ করলেও তথ্য সঠিক ছিলো না। তদন্তকারী কর্মকর্তা গোলাপগঞ্জের মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ-এফপি) ডা: উচিত কুমার সিনহা তার বাড়ির ঠিকানা সঠিক নয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। কিন্তু এরপর পুনরায় তার হাত ধরেই যোগদান করেন পলি সাহা।
অভিযোগ রয়েছে, সিলেট সদর উপজেলার পরিবারকল্যাণ সহকারী চন্দন কুমার রায়ের মাধ্যমে পলি সাহা ডিডি ডা: লুৎফুন নাহার জেসমনিকে ম্যানেজ করে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন।
গোলাপগঞ্জের মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ-এফপি) ডা: উচিত কুমার সিনহা দাবি করেন, অফিসের আদেশ পেয়ে তিনি পলি সাহাকে যোগদানের সুযোগ করে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সিলেট সদর উপজেলার পরিবারকল্যাণ সহকারী চন্দন কুমার রায় দাবি করেন, এই বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে, গত মাসের শেষ সপ্তাহে সোনালী ব্যাংকে ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা ও পরবর্তীতে সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গানো নিয়ে চন্দন রায়কে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হয় তাকে। চন্দন রায় দাবি করেন, ওই টাকার তার বোনের। অফিসের নিরাপদ প্রজেক্ট এর ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা তার কাছে রয়ে গিয়েছিলো। ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সঞ্চয়পত্র ভেঙ্গেছেন। বাকি টাকা দিয়ে এনআরবিসি ব্যাংক-এর একটি লোন পরিশোধ করেছেন। ওই টাকা তার বোনের কাছ থেকে প্রাপ্ত বলে চন্দন রায় দাবি করেন।
এ ব্যাপারে এয়ারপোর্ট থানার ওসি মইন উদ্দিন জানান, একজন সরকারি কর্মকর্তা বাদী হয়ে ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্তে যার নাম পাওয়া যাবে, পুলিশ প্রতিবেদনে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পুলিশ বিষয়টি নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানান ওসি।
এব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান জানান, জেলা পরিবার পরিকল্পনার কার্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। বিষয়টি বাস্তবায়নে আন্তরিক রয়েছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক। তিনি বলেন পর্যায়ক্রমে সবাই আইনের আওতায় আসবে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ৮ জনের বাইরেও আরো দুইজনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো: কুতুব উদ্দিন জানান, জনবল নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আমরা পেয়েছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৮জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। ডা: লুৎফুন নাহার জেসমিনকে এজাহারে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশনাটি মামলা দায়েরের পরদিন এসেছে, আমরা পুলিশকে তাদের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি।
উল্লেখ্য, গত ২২ মার্চ ‘লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা না দিয়েও নিয়োগ পেলেন ৯ পরিবারকল্যাণ সহকারী’ শিরোনামে-দৈনিক সিলেটের ডাক-এ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। রিপোর্ট প্রকাশের পর সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়। এরপর থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।