বেসরকারি চিকিৎসা খাতে শৃঙ্খলা প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪৮:৪৯ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী:
চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই চিকিৎসা প্রত্যাশী মানুষ বিশেষ করে দারিদ্র ও উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী যাতে চিকিৎসা সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করা জরুরি। চিকিৎসাসেবা মূলত সেবাধর্মী পেশা। যারা এ পেশায় নিয়োজিত আছেন তারা মানব ধর্মও পালন করে থাকেন। চিকিৎসক হয়ে তারা এ শপথই নিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের সাফল্য যখন বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে তখন দেশের বেসরকারিখাতে চলছে নৈরাজ্য। কিছু সংখ্যক অর্থলোভী চিকিৎসকের অনৈতিকতা ¤øান করে দিচ্ছে এ মহান পেশাকে। বাস্তবে যা হচ্ছে তা একমাত্র ভূক্তভোগীরাই জানেন। বেসরকারি চিকিৎসা খাতে সুষ্ঠু নীতিমালা ও আইন না থাকায় এ ধরনের অনৈতিক কাজ, অমানবিক বাণিজ্য চলছে । ফলে স্বার্থান্বেষীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন রোগীর পকেট। মহান এ পেশা টু-পাইস কামানোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বলা যায় এখন বিরাট বাণিজ্যই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
এ কথা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শুধু চিকিৎসকরা নয়, এক্ষেত্রে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, ক্লিনিক এবং মেডিকেল কলেজসমূহ এক কাতারে। সর্বক্ষেত্রে ফিস আদায়ে চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা। আকাশছোঁয়া চিকিৎসা খরচ ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি বাবদ খরচ মেটাতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা সর্বস্বান্ত। সেবাগ্রহীতা ও ভর্তি প্রার্থীদের মনে প্রশ্ন এগুলো দেখার কি কেউ নেই? সরকারের মাথাব্যথা থাকলে এই নৈরাজ্যের লাগাম টেনে ধরা যেত।
প্রায়শ রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে বচসা, অপ্রীতিকর ঘটনাসহ ভাঙচুরের সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়। এ সংবাদ পড়ে আমরা কেউ আনন্দ পাই। আবার কেউ শ্লাঘা অনুভব করি। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ল্যাব, ক্লিনিক, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে উঠা এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোতেই নেই অনুমোদন। নেই মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা। অন্যদিকে জমকালো চেম্বার নিয়ে বসে আছেন ভূয়া ডাক্তাররা। খোদ সিলেট শহরের ডাক্তারপাড়া নামে খ্যাত স্টেডিয়াম মার্কেট ও মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন এলাকায় এরকম ঘটনা ঘটেছে, এমন খবর আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখেছি একাধিকবার। এতে আসল এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে ডাক্তার, হাসপাতাল, ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের আদায়কৃত ফি অত্যধিক বলে ভুক্তভোগীদের মনে ক্ষোভ। এর মূল কারণ বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন আজ পর্যন্ত প্রণীত না হওয়ার সুযোগে যেভাবে যে পারে ফায়দা লুটে খাচ্ছে।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রণীত হয়েছিল জাতীয় ওষুধনীতি। এই নীতিমালার আলোকে দেশে গড়ে উঠা ওষুধ শিল্পখাতে ফিরে আসে শৃঙ্খলা। তার ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশ নিজের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে ওষুধ রফতানি করতে সক্ষম হয়েছে। রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় ওষুধ অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্যি গর্বের ব্যাপার।
যদি বেসরাকরি চিকিৎসা সেবা আইন প্রণীত হতো, তবে এ ক্ষেত্রে ফিরে আসতো শৃঙ্খলা। উন্নতির প্রধান শর্ত হলো-শৃঙ্খলা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসাখাত শিল্পখাত হিসাবে বিবেচিত ও সমাদৃত। এ খাত থেকে তাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। অবশ্য সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের কিছু উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন মানসম্পন্ন হাসপাতাল ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাও আছেন। ফলে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য এখন বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে বেশ উন্নত চিকিৎসা বিদ্যমান। কিন্তু নীতিমালা ও আইন প্রণয়ণ করা না হলে স্বেচ্ছাচারিতায় এ শিল্পখাত মুখ তুবড়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। এ খাতকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হলে এ শিল্পে বিপ্লব সাধিত হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে যেমনি তেমনি গড়ে উঠবে দক্ষ জনশক্তি ও চিকিৎসকের মানসিক গঠন ও আচার-আচরণ।
এ প্রসঙ্গে আমি একজন নিম্নবিত্ত রোগীর আকুতি দেখেছি। তিনি একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে জানলেন তার ফি ৮০০ টাকা এবং রিপোর্ট দেখানোর সময় ৩০০ টাকা। ঐ ব্যক্তিটি ফি কমানোর জন্য ডাক্তার সাহেবেরএ্যাটেনডেন্টের কাছে কাকুতি মিনতি করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি সব টাকা দিয়ে চিকিৎসা নেন। আবার ঠিক তার বিপরীত দৃশ্যও দেখেছি সিঙ্গাপুরে। হাসপাতালে এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ শেষে তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। আমাদের সাথে নেয়া ডলার অপ্রতুলতা ও তা নগদ করতে না পারায় পরদিন তা করার জন্য অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাদের কাছে তার কারণ জেনে বললেন, আপনারা বিদেশী, একদিন বেশি থাকা মানে অর্থব্যয়। কেন অযথা বেশী খরচ করবেন। এই বলে তিনি তার পকেট থেকে সমস্ত টাকা বের করে বললেন ‘নিন যা লাগে’। সাথে সাথে বিল সেকশনে বলে দিলেন, অমুক রোগীর কাছে থেকে যেন ৩০% কর্ম চার্জ নেয়া হয়। ঐ মহতি ডাক্তার এটা না করলেও পারতেন। আমরা তার কাছে কোনো সাহায্য চাইনি। অথচ আমাদের ডাক্তার সাহেবরা কেউ কেউ এমন হলে তো রেগেই যেতেন। সিঙ্গাপুরের ডাক্তারও সেবা দান করেন আর আমাদের ডাক্তাররাও সেবা দান করেন। পার্থক্য শুধু মানসিকতা আর আচরণের। আমাদের ডাক্তারদের সাথে কথা বলা যায় না। তেড়ে আসেন অনেকেই। এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়। তবে সামগ্রিকভাবে আমাদের সেবার খাত অনুদার ও অমানবিক। রোগীর কথা শোনার মতো ধৈর্য্য তাদের অনেকেরই নেই। রোগী তার কষ্টের কথা বলতে থাকে আর ডাক্তার সাহেব খচখচ করে লিখতে থাকেন ব্যবস্থাপত্র। সম্প্রতি একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সম্পর্কে জানি, যার বাবা একজন প্রথিতযশা ডাক্তার। সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়মিত চিকিৎসা করান একজন প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ঐ রোগী তার ডাক্তার কন্যাকে সাথে নিয়ে একদিন চিকিৎসাপত্রের জন্য যান। যাওয়ার সময় তার কন্যা বাবার অস্বাভাবিক রক্তচাপের কারণে দ্রæত তার কাছে নিয়ে যান। কিন্তু সৌভাগ্যবশত: ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার পর রোগীর রক্তচাপ কমে যায়। বিষয়টি তিনি ডাক্তারকে জানালেন যে, বাসায় আমার কন্যা রক্তচাপ বেশি পেয়েছে। আর যায় কোথায় ঐ তরুণ ডাক্তারকে অকথ্য ভাষায় ধোলাই করলেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সাহেব। ফলশ্রæতিতে ঐ রোগী যখন কোন এক সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি জানালেন, মরে যেতে পারি কিন্তু ঐ ডাক্তারের কাছে যাব না এবং তিনি আর যাননি। এই হচ্ছে আমাদের কোন কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মানসিকতা। সিঙ্গাপুরে একজন ডাক্তার সর্বোচ্চ ১০-১৫ জন রোগী দেখেন। আমাদের দেশে ১০ জন থেকে ১০০ জনও দেখে থাকেন। সিলেটে একজন সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গভীর রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন টেলিভিশন দেখে দেখে এমন খবর আমাদের কাছে আছে। আরও একজন ডাক্তার সাহেবকে জানি তিনি সারা রাত রোগী দেখেন ক্লিনিকে এবং অপারেশনও করেন রাতব্যাপী।
শুধু চিকিৎসকের ফি নয়, হাসপাতাল, ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, মেডিকেলে ভর্তি, অপারেশন, বেড ভাড়া, রিং পরানো, সিজার অপারেশনসহ সকল ক্ষেত্রেই চলছে ফিস আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা। কোন কোন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি বাবদ নেয়া হয় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা। আকাশছোঁয়া চিকিৎসা খরচ কিংবা মেডিকেলে ভর্তি বাবদ খরচ মেটাতে সেবাগ্রহীতা কিংবা অভিভাবক হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। এদের তদারক করার কোন নীতিমালা না থাকার কারণে বাড়তি ফির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি, হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ফি, ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ফি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আইন প্রণয়ণের জন্য একাধিকবার প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকপক্ষ এতই শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান যে ঐ প্রস্তাবসমূহ বস্তাবন্দী হয়ে হিমঘরে পড়ে আছে। ২০১০ সালে প্রথম যখন সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ এমবিবিএস, বিডিএস কোর্সে একসঙ্গে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তখন স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের অফিস হতে ফি আদায়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের জন্য ভর্তি ও টিউশন ফির সর্বোচ্চ হার নির্ধারণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। তাতে ভর্তি ফি সর্বোচ্চ আট লক্ষ টাকার প্রস্তার করা হয়। এ উদ্দেশ্যে তিনটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু প্রাইভেট কলেজ মালিকদের প্রবল চাপে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ.ফ.ম রুহুল হক পিছিয়ে যান। ফলে উক্ত প্রস্তাবসমূহ লাল ফিতায় বন্দী হয়ে আছে। একইভাবে মরচুয়ারীতে ঘুমিয়ে আছে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা আইন। আইন না থাকার কারণে স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলার অভাবে এই শিল্প মাধ্যমটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প হিসাবে বিকশিত হচ্ছে না।
আমাদের সরকারি হাসপাতালের সেবার মানও অতি নিম্নস্তরের বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ দেশের দরিদ্র ও উপেক্ষিত জনগণ বাধ্য হয়ে সেখানে ভিড় করে। দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে যত দ্রæত সম্ভব বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন প্রণীত হওয়া অতি জরুরী।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।