মানবিক প্রশাসন ও বঙ্গবন্ধুর দর্শন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩৮:০২ অপরাহ্ন
শেখর ভট্টাচার্য:
সাধারণ মানুষের রক্ত লাল। অসাধারণ রাজ বংশজাত মানুষের রক্ত নীল। যেমন ব্রিটিশ রাজপরিবারের রক্ত নীল বলে বলা হয়ে থাকে। শ্বেতবর্ণ ইংরেজরাও নীল রক্তধারী কারণ তারা রাজার জাত। কৃষ্ণ কিংবা বাদামী বর্ণের মানুষেরা বড়ই সাধারণ। চার্চের পুরোহিতরাও ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন শ্বেতবর্ণ এবং কৃষ্ণবর্ণ মানুষদের। তারা বলতেন ঈশ্বর এই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন। জ্ঞান, বুদ্ধি, আভিজাত্যে শ্বেতবর্ণের মানুষেরা অনেক উচ্চ শ্রেণির।
আমাদের দেশের নীল রক্তধারী শাসকেরাও নিজেদেরকে অনেকটা ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সমান মনে করেন। তাদের পূর্বসুরীদের ব্রিটিশরা শিখিয়ে দিয়ে গেছে আভিজাত্য কী এবং কী ভাবে বজায় রাখতে হয়। দুঃখের বিষয় যারা শিখিয়ে দিয়েছিলো তারা কিন্তু নিজেদেরকে বদলে ফেলেছে। গ্র্যান্ডন রিভ্যুলিশনের পর সব পাল্টে গেছে ব্রিটেনে। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সেই দাপট নেই তাদের আছে শুধু প্রতীকী সম্মান। তারা প্রতীকী প্রধান বা টিট্যুলার হেড। আমাদের প্রশাসকদের সম্মান, ক্ষমতা দুটোই আছে। তারা প্রতীকী প্রধান নন, তারা প্রকৃত প্রধান।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসকদের আকুল ভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, কে করেছে অনুরোধ? স্বয়ং জাতির পিতা।পাকিস্তান থেকে ফিরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সাধারণদের তিনি কেন্দ্রে রেখে দেশ পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে। স্বাধীন দেশে এটি ছিলো একটি গুরুত্ব পূর্ণ কাজ। সে কাজ তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতো অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিলো। কাজটি অসমাপ্ত থেকে যাওয়ায় নীল রক্তধারীরা স্বাধীনতার অসীম ব্যবহার করতে ভুল করছেন না।
১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, এটি ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে দেয়া তাঁর শেষ ভাষণ। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রশাসক ও শিক্ষিত বাঙালিদের উদ্দেশ্যে কিছু গুরুত্ব পূর্ণ কথা বলেছিলেন। স্বাধীন দেশের দূরদর্শী নেতা হিসেবে, এটি ছিলো অনেকটা দার্শনিক নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে শিক্ষিত বাঙালি ও সরকারী কর্মকর্তাদের যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরেও সেসব নির্দেশনাকে প্রাসঙ্গিক মনে হয়। দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতা সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। আমরা গাড়ী চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে। সরকারী কর্মচারীদের বলি, মনে রেখ এটা স্বাধীন দেশ। এটা বৃটিশের কলোনী নয়। পাকিস্তানের কলোনী নয়। যে লোককে দেখবে তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভায়ের মত, ওরই পরিশ্রমের পয়সা, ওরাই সম্মান বেশী পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়’ এই যে মানসিকতা পরিবর্তন করে স্থিতি অবস্থাকে ভেংগে দেয়ার উদ্যোগ, এটি বড় মারাত্মক। বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক গুলো কারণ রয়েছে এর মধ্যে বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগ হলো অন্যতম।
বঙ্গবন্ধু যাদের রাষ্ট্রের মালিক বলেছিলে, তারা প্রান্তে চলে গেছেন। সমাজ বিশ্লেষক, উন্নয়ন বিজ্ঞানীরা তাদেরকে প্রান্তিক মানুষ বলেন। কেন্দ্রে আছেন দাপুটে প্রশাসক, ব্যসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক, বেসামরিক আমলা এবং ‘রাজনীতি ব্যবসায়ী’। এক কথায় বলতে গেলে, এখন সবাই ‘রাজনীতি ব্যবসায়ী’। রাজনীতিকে পুঁজি করে তারা ব্যবসা করেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী মানুষ। তিনি বুঝেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এসব মানুষেরা পথের বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ওই ভাষণে অনুরোধ করেছিলেন, নিজেদের পরিবর্তন করার জন্য। তাদের মধ্যে আমরা কোন পরিবর্তন দেখিনি, বরঞ্চ রাষ্ট্রকে তারা লন্ডভন্ড করে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলো। ওই যে বলে ঘোলা জলে মাছ শিকার করা, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা নীরবে ঘোলা জলে মাছ শিকার করেছেন। বঙ্গবন্ধু একই ভাষণে সুযোগ সন্ধানী শিক্ষিত মানুষদের বলেছিলেন ‘শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আমি যে এই দুর্নীতির কথা বললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? বøাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশী এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। …শিক্ষিত সমাজকে একটা কথা বলব, আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। একজন কৃষক যখন আসে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে আমরা বলব, এই বেটা কোন্থেকে আইছিসস, বাইরে বয়, বাইরে বয়। একজন শ্রমিক যদি আসে বলি, এখানে দাঁড়া। এই রিকশাওয়ালা, ঐভাবে বলিস না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে। তুচ্ছ করে। এর পরিবর্তন করতে হবে। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব কৃষক।‘ বঙ্গবন্ধুর মতো রাষ্ট্রনেতা আর কি ভাবে জাতির মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই অংশটি যখন পড়ি, তখন চোখ আদ্র হয়ে ওঠে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় বার বার মাথা নত হয়ে আসে। সাধারণ মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসার গভীরতাকে মাপার চেষ্টা করি। সকল সময়ে সমাজের ‘চেঞ্জমেকার’ বা ‘গেমমেকার’ হিসাবে বিবেচনা করা হয় শিক্ষিত পেশাজীবী ও শিক্ষিত মানুষদের। পরিবর্তনের শক্তি হিসাবে তারা কাজ করে থাকেন, ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যেভাবেই বিষয়টিকে আমরা বিবেচনা করিনা কেনো। তাদেরকে তাই শাসকদের বড় ভয়। তাদেরকে আস্থায় নিয়েই শাসকেরা কাজ করতে সাছ্বন্দ বোধ করেন।
আমাদের শাসক বদলেছে সাতচল্লিশে একবার, একাত্তরে আর একবার কিন্তু আমাদের প্রশাসকদের পরিবর্তন ঘটেনি। প্রশাসকেদের চেয়ারে নুতন মানুষের স্থান হয়েছে কিন্তু নুতন মানসিকতার স্থান হয়নি। স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসক কোথায়? প্রশাসকেরা নিজেদেরকে নিজেরাই প্রশাসক হিসাবে তৈরি করেছেন।মাঠ প্রশাসনে যারা আছেন তাদের পদবী হওয়ার কথা ছিলো সেবক। জেলা পর্যায়ে জেলা সেবক একই ভাবে বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নানা দায়িত্বের মানুষের নানা ধরণের সেবক হিসাবে পদবী দেয়া উচিৎ ছিলো। ডেপুটি কমিশনার শব্দকে বাংলা ভাষায় রুপান্তরিত করলে কোন ভাবেও জেলা প্রশাসক বলা যায়না। একসময় যখন মহকুমা ছিলো তখন মহকুমার প্রধান সেবক যিনি ছিলেন তার তার পদবী ছিলো সাব ডিভিশনাল অফিসার সংক্ষেপে এসডিও। বাংলায় রুপান্তর করলে তাকে মহকুমা কর্মকর্তা বা প্রধান মহকুমা কর্মকর্তা বলা যেতো কিন্তু বুদ্ধি করে এর রুপান্তর করা হয়েছিলো ‘মহকুমা প্রশাসক’ যেমন জালা পর্যায়ের প্রধান সেবককে বলা হয় ‘জেলা প্রশাসক’।
বঙ্গবন্ধু স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে আমি বিশ্বাস করি প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যেতো। কারণ তিনি ‘মুক্তির’ সংগ্রামের অগ্রনায়ক ছিলেন। তার হাত ধরে সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তি আন্দোলন সফলতার দ্বার গোড়ায় পৌছুতো। বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়ার অনেক গুলো কারণের মধ্যে স্থিতাবস্থার পরিবর্তনের জন্য তার উদ্যোগ অন্যতম। স্থিতাবস্থা বা বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে দেশের প্রশাসকরা প্রকৃত অর্থে জনসেবক হয়ে উঠতেন। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের উপর জেঁকে বসতে পারতোনা। আমাদের প্রশাসকদের অফিস বা সেবা কেন্দ্র যদিও বিকেন্দ্রীত হয়ে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্থানাতরিত হয়েছে কিন্তু প্রশাসকরা মানসিক ভাবে সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরে গেছেন। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রশিক্ষন হলো, সাধারণ, প্রান্তিক মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া। প্রশিক্ষনে নানা ভাবে শেখানো হয় দূরে সরে যাওয়ার কথা। কাছে আসলে সস্তা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, মূল্যহীন হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে, শাসকের চোখের দিকে তাকিয়ে সাধারণের কথা বলার সাহস সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয়। নীল রক্তের মানুষদের তাই দূরে থাকতে হয়।
সাধারণ মানুষের কাছে দিনে দিনে আমাদের দেনা বেড়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে এই সাধারণ মানুষেরাই ছিলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই দেনা পরিশোধ করতে হলে আমাদের অনেক বিষয়ের মতো আচরনের সংস্কৃতি পরিবর্তন করা জরুরী। এ’বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর দার্শনিক নির্দেশনা আমাদের পথ দেখাতে পারে। আমরা কী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা শুনতে পাচ্ছি? শিক্ষিত সমাজকে একটা কথা বলব, আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র দর্শনকে মাস্তুল বানিয়ে আমাদের এগিয়ে চলা উচিৎ।
লেখক : প্রাবন্ধিক।