সমাজ জীবনে রোজার প্রভাব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪১:০৬ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
মাহে রমযানে আমাদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি বৃদ্ধি পায়। যদ্দরুন যাবতীয় কাজ-কর্মে বিশেষ গতি ফিরে আসে। কাজে গতি আসলে সমাজের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়।
রোজাদারগণ কাজে যেমন নিষ্ঠাবান হয়ে উঠেন তেমনি কথা-বার্তায়ও সত্যপরায়ণ হয়ে উঠেন। কেউ কাউকে ঠকানোর চেষ্টা করেন না বরং অপরের অধিকার বুঝিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকেন। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি, হৃদ্যতা ইত্যাদি বেড়ে যায়। এভাবে সমাজব্যবস্থা হয়ে উঠে সাবলীল-সুখময়।
মাহে রমযানে মুসলিম সমাজ সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, কটু কথা ও অশ্লীলতা-বেহায়াপনা পরিহার করে একটি সুন্দর জীবন যাপনে ব্রতী হয়। কেউ কোন রোজাদারকে গালি দিলেও সে হাদীসে রাসূল (সা.) অনুসারে বলে দেয়- ‘আমি রোযাদার’। এরূপ পরিবেশ যেখানে বিদ্যমান থাকে সেখানে আদৌ ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে না। ফলে সমাজে অবধারিতভাবেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত থাকে।
রমযানের রোজার প্রভাবে মুসলিম সমাজে সকল প্রকার লোভ-লালসা হ্রাস পায়। ফলে যাবতীয় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একে অপরকে বিশ্বাস করে, ভালবাসে। সকলেই ওয়াদা-আমানত রক্ষা করে চলতে সচেষ্ট হয়। এছাড়া রোযার প্রভাবে যেহেতু কু-প্রবৃত্তিসমূহ অবদমিত হয় সেহেতু সমাজের মানুষের মধ্যে শংকা থাকে না, নিরাপত্তার কোনরূপ অভাব বোধ হয় না। গোটা সমাজেই এরূপ অবস্থার প্রতিফলন ঘটে।
আমাদের সমাজে মাহে রমযানে ভ্রাতৃত্ব-ভালবাসা, ভদ্রজনোচিত আচরণ, দানশীলতা ইত্যাদি যেমনটি প্রত্যক্ষ করা যায় অন্য সময়ে তেমনটি কল্পনা করতেই কষ্ট বোধ হয়। এ মাসকে কেন্দ্র করেই বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমবয়সীদের প্রতি সৌহার্দ্য ও ছোটদের প্রতি স্নেহের মাত্রা বেড়ে যায়। এভাবে আমরা একটি বেহেস্তী পরিবেশ অনুভব করি।
রমযান মাসে মুসলিমগণ তাদের অধীনস্তদের প্রতি অন্য সময়ের তুলনায় বেশী সদয় হন। অনেকেই তাদের খাটুনিকে কমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসে অধীনস্তদের বোঝা হালকা করে দিবে তাকে আল্লাহ্ মাফ করে দেবেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন। মুসলিমদের মধ্যে এর অনুশীলন হয় যার প্রভাব সমাজে পড়ে । ফলে মালিক-শ্রমিক সকলের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সুসম্পর্ক অর্থনীতির চাকাকে মজবুত করে।
এ মাসে দানশীলতা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। বিশেষত: রোজাদারগণ গরীব-দুঃখী, অসহায় এতিম- মিসকীনদের প্রতি তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ফলে তাদের মাঝে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। সাধারণ দান ছাড়াও বিত্তবানগণ ফিতরা, যাকাত ইত্যাদি আদায় করে থাকেন। এভাবে সমাজের একটি বিরাট অংশ রোজা দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের জন্য মাহে রমযান সত্যিই আশীর্বাদস্বরূপ ।
রমযান মাসে বিভিন্ন অফিস-আদালতের কাজে জবাবদিহিতা ও দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর সেই হাদীস স্মরণযোগ্য। ‘সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’। তাই আমরা দেখি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আত্মপর্যালোচনার সাথে তাদের কাজ-কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। এভাবে কাজ করলে কাজ অনেক সুচারুরূপে সম্পাদিত হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতি বিধান হয়।
মাহে রমযানে আমাদের সমাজে এক অভূতপূর্ব ঐক্য, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ বিরাজ করে থাকে। ধনীব্যক্তিগণ রোজা রাখার ফলে দরিদ্রের কষ্ট কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারেন। ফলে তারা হতদরিদ্র মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। এছাড়া একত্রে তারাবীহ নামাজ আদায় করা কিংবা একত্রে ইফতারীর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি সামষ্টিক কাজের দরুন উঁচু-নীচু, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ অনেকাংশেই বিলীন হয়ে যায়।
এ মাসের মর্যাদা রক্ষার্থে মুসলিম সমাজের পাশাপাশি অমুসলিম স¤প্রদায়ও অনেক ভূমিকা রেখে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ইতিপূর্বে ভারতে হিন্দু স¤প্রদায়ের বেশ কয়েক জন সদস্য বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে এবং রোজা থেকে কল্যাণ লাভের আশায় মুসলমানদের সাথে রোযা পালন করেছেন। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে মাহে রমযানকে সম্মান দেখানোর এরূপ ঘটনা ইতিহাসে অনেক রয়েছে।
অতএব, মাহে রমযানের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনকে সুন্দর ও পরিমার্জিত করার মধ্য দিয়ে আমরা যাতে একটি কাক্সিক্ষত কল্যাণকর সমাজ কায়েম করতে পারি যেমন কায়েম করেছিলেন বিশ্বনবী (সা.)।
লেখক : প্রাবন্ধিক।