কুসুমকুমারী দাশ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ৩:২৪:০২ অপরাহ্ন
ফাহমিদা ইয়াসমিন
বিপদ আসিলে কাছে, হও আগুয়ান,
নাই কি শরীরে তবে রক্ত মাংস প্রাণ?
চেতনাকে সঙ্গী করে যে ক’জন নারী সমাজের মানুষের চোখে আলোর প্রদীপ জ¦ালাতে চেয়েছেন। তারা তো মহান, মহীয়সী নারী। ১৮৭৫ সালে জন্ম নিয়েও যে নারী কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষকে জানান দিয়েছেনÑ হাত পা সবারি আছে, মিছে কেন ভয়,/ চেতনা রয়েছে যায়, সে কি পড়ে রয়?’।
বিষয়টি ভাবলে অনেকেই বিস্মিত হবেন। ১৮৫৭ সালে জন্ম নিয়েও বিপদ আসিলে কাছে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। কিভাবেই বা বুঝতে হয় জীবনের মানে। তিনি বাঙালি নারীদের জানিয়ে দিয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। তাই তো তিনি বলেছেনÑ বিপদ আসিলে কাছে, হও আগুয়ান,/ নাই কি শরীরে তবে রক্ত মাংস প্রাণ?
শুধু নারী নয়, তিনি নারীÑপুরুষ উভয়কে নিয়ে লিখেছেন সমানতালে। সেই যুগে বাস করেও আধুনিকতার শ্রেষ্ঠ দাবিদার বলা যায়। এই মহান নারী কবি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের মা। অনেকেই তাকে চেনেন না। অনেকেই জানেনও না এই নারী কবির পিতাও একজন কবি ছিলেন। এই নারী কবির নাম কুসুমকুমারী দাশ। তিনি খুব বেশি লিখে যাননি কিন্তু যেটুকু রেখে গেছেন তাতে তার প্রতিভার ছাপ সুস্পষ্ট। তারপরও কুসুমকুমারী দাশের প্রতিভার মূল্যায়ন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শুধু যে কুসুমকুমারী দাশের প্রতিভার মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি তা কিন্তু নয়। বরং বাংলা সাহিত্যের অমর
কীর্তি অনেক কবি সাহিত্যিকের যথার্থ মূল্যায়নে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা সাহিত্য বিচার না করে কখনো রাজনীতি কখনো হিংসার বশবর্তী হয়ে এমনটা করেছি। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত প্রথম যে নামটি আসে তিনি হলেনÑ জীবনানন্দ দাশ। যার জীবদ্দশায় তাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এরপরেই আসে কবি ফররুখ আহমেদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হওয়ার পরও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।
১৮৭৫ সালে কুসুমকুমারী দাশ বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা চন্দ্রনাথ দাশ আর মাতা ধনমণি দাশ। চন্দ্রনাথ দাশ কবিতা লিখতেন। পিতার লেখালেখি ও পড়াশোনাই সম্ভবত কুসুমকুমারী দাশকে কবিতাপ্রেমী করে। হয়তো সে কারনেই কুসুমকুমারী দাশ লেখার ক্ষমতা পেয়েছিলেন। এই ধারা অব্যাহত থাকে যখন তার সুযোগ্য পুত্র জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে অমরকীর্তি হন। মাÑছেলে দু’জনেই হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের বটমূল। যাদেরকে কবিতা বাঁচিয়ে রেখেছে আর রাখবেও।
ছোটবেলা থেকেই কুসুমকুমারীর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। একের পর এক কবিতা লিখতে থাকেন। আর সেসব কবিতা ছাপা হতে থাকে স্বনামধন্য সাহিত্যপাতায়। তার কবিতা নিয়মিতভাবে ছাপা হতে থাকেÑ মুকুল, ব্রাহ্মবাদী, প্রবাসী প্রমুখ পত্রিকায়।
কুসুমকুমারী দাশ কলকাতার বিখ্যাত বেথুন স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তখন তার বয়স ছিল ১৯। স্বামীর নাম ছিল সত্যানন্দ দাশ। কুসুমকুমারী সন্তানদের নাম রেখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ, আশোকানন্দ দাশ এবং সুচরিতা দাশ। এদের মধ্যে পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কুসুমকুমারী দাশ। তিনি একই সাথে বহুগুণে গুণান্বিত ছিলেন। কবিতা লেখায় যেরকম পারদর্শী ছিলেন ঠিক সেই রকম ছিলেন গৃহকর্মের কাজেও। একই সাথে করতেন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নে নানান কাজ। ব্রাহ্ম সমাজের মহিলা সদস্যও ছিলেন তিনি। তিনি পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের নারী জাগরণের জন্য নানান পদক্ষেপ নেন। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের মহিলাদের স্বাবলম্বী হতে এবং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন। কিভাবে নিজেকে চিনতে হয়, নিজেদের কর্মে আত্মবিশ্বাস রাখতে হয়। এই অঞ্চলের নারীদের তিনি প্রথম জানিয়ে দেন। শিখিয়ে দেন হাতে-কলমে। তিনি লিখেছেনÑমনুষ্যত্ব শিরোনামের কবিতায়Ñ একদিন লিখেছিনু আদর্শ যে হবে ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। আজ লিখিতেছি বড় দুঃখ লয়ে প্রাণে/ তোমরা মানুষ হবে কাহার কল্যাণে?
কবির মধ্যে অসম্ভব নেতৃত্বগুণ ছিল। তিনি নেতৃত্ব দিতেন। বাংলা ১৩১৯ থেকে ১৩৩৮ পর্যন্ত তিনি ব্রাহ্মসমাজের আধ্যাত্মিক নেতার দায়িত্ব পালন করেন। কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল মহিলা সমাজের সভানেত্রীও ছিলেন। নেতৃত্বগুণ ছিল বলেই হয়তো তিনি লিখতে পেরেছেন তার অমর কবিতা। যে কবিতাটি পড়ে আজও বাংলাভাষীরা নিজেদের মধ্যে নিজেকেই আবিস্কার করতে আত্মমগ্ন হয়। তার কবিতায় একই সাথে পাওয়া যায় প্রকৃতি, প্রেম, দেশমাতৃকার প্রতি বিন¤্র ভালোবাসা, মানুষের প্রতি মানুষের দায়বন্ধতার জয়গান। তিনি গল্প ও প্রবন্ধ লিখলেও কবিতাতেই তাঁর হাত যে শক্ত ও পোক্ত তা তাঁর কবিতা পড়লেই পাঠকের বুঝতে দেরি হবে না। ছন্দবন্ধ কবিতাগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লেই একটা গল্প, একটা জীবন, একটা সমগ্র পৃথিবী সম্পর্কে প্রোথিত চিত্র পাওয়া যাবে। তিনি লিখেছেনÑ
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?/ মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন/ ‘মানুষ হইতে হবে’Ñএই তার পণ,/ বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান,/ নাই কি শরীরে তব রক্ত মাংস প্রাণ?/ হাত, পা সবারই আছে মিছে কেন ভয়।
(কবিতা : আদর্শ ছেলে)
কুসুমকুমারী দাশের ছেলে বলেছেনÑ সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি। তিনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। তার এই কথাকে অধিকাংশ সাহিত্যকর্মী সমর্থন করে। তার ছেলের কথার সূত্র ধরেই বলতে হয় কুসুমকুমারী দাশ একজন জাত কবি। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। কাব্যকুমারী, পৌরাণিক আখ্যায়িকা, কুসুমকুমারী দাশের কবিতা এবং দৈনন্দিন দিনলিপি তার রচিত গ্রন্থ। এসব লেখায় তার মুনশিয়ানা সহজেই চোখে পড়ে। কাব্য মুকুল (১৮৯৬) তার কাব্যগ্রন্থ।
‘পৌরাণিক আখ্যায়িকা’ গদ্যগ্রন্থ।
মা কুসুমকুমারী দাশ সম্বন্ধে এক নিবন্ধে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়েছিলেন। খুব সম্ভব ফার্স্ট ক্লাস অবধি পড়েছিলেন, তার পরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভালোই করতে পারতেন, এ বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তার বেশি শক্তি ছিল মনে হচ্ছে।’
(আমার মা বাবা)
কুসুমকুমারী দাশ মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত। কবিতায় তুলে এনেছেন সমাজের চিত্র। প্রকৃতির রূপ, মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা, প্রেম, দ্রোহ, বিরহ এমনকি সমাজ সচেতনতা। তার বড় কৃতী কবিতার মাধ্যমে মানুষ সচেতন করা, সমাজের প্রতি, নিজের প্রতি সচেতন হওয়া। কবিতার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন সমাজের সাধারণ মানুষকে। দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজে মানুষের নিজের অবস্থান। এটাই কবির সার্থকতা। তিনি লিখেছেনÑ বঙ্গের ছেলে-মেয়ে জাগো, জাগো, জাগো,/ পরের করুণা কেন শুধু মাগোÑ/ আপনারে বলে নির্ভর রাখো/ হবে জয় নিশ্চয়/ চারিদিকে হেরো কী দুঃখ-দুর্দিন,/ কত ভাই বোন অন্ন-বস্ত্র-হীন।
(কবিতাÑউদ্বোধন)
কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে তিনি ভালো একজন প্রাবন্ধিকও ছিলেন। লিখেছেন প্রবন্ধও। প্রবন্ধ লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন স্বর্ণপদক।
১৯৪৮ সালে কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনেক গুণী এই কবির কথা বাংলা সাহিত্য অনেকদিন মনে রাখবে। কারণ তিনি যে সময় কাব্যচর্চা বা লেখালেখি করতেন সে সময়ের মেয়েরা অনেক পিছিয়ে ছিল। তার লেখা বা কবিতার আর প্রসার হোক এই প্রত্যাশা করি।
তথ্যসূত্র : ১. শালুক : জীবনানন্দ দাশ পাঠÑপারাপাঠ ২৪/ ২. অÑপাঠ: জীবনানন্দ দাশ- ২০১৯/ ৩. কবিমাতা, ধরলা-২০০৯