শহীদ ডা. শামসুদ্দীন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:২১:১৬ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
পাকিস্তানী হানাদার জল্লাদ বাহিনী একাত্তরের ৯ এপ্রিল সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জঘণ্য হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস দখলদার বাহিনী সারা বাংলাদেশে এরকম বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীনতার ভয়ানক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তাদের বর্বরতা থেকে সেদিন যেমন রক্ষা পায়নি নারী-শিশু-বৃদ্ধ তেমনি রক্ষা পায়নি ডাক্তার-নার্সরা পর্যন্ত। বর্বর দখলদার সেনারা সভ্যদুনিয়ার সকল রাজনীতি ও রেডক্রসের আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন পদদলিত করে সেদিন সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যশস্বী ডাক্তার শামসুদ্দীন আহমদ, ডা. শ্যামল কান্তি লালাসহ সেবাকার্যে নিয়োজিত ১২/১৩ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।
সিলেট মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমদ ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী একজন নামকরা শৈল্যচিকিৎসক ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবী। শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রেই যশস্বী ছিলেন না তিনি, একজন কৃতী শিক্ষক ও বলিষ্ট সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন তিনি। যেমন শিক্ষকতায় ও চিকিৎসায়, তেমনি নীতি-আদর্শ ও ব্যক্তিত্বে অনন্য ছিলেন ডা. শামসুদ্দীন। বড় মাপের হৃদয়ের অধিকারী ডা. শামসুদ্দীন দেশপ্রেম ও মানব সেবাকে পেশার সাথে এক করে নিয়েছিলেন। দেশ ও দেশের মানুষকে সেবার মহান লক্ষ্যে তিনি ডাক্তার হওয়ার প্রেরণা লাভ করেছিলেন। মানুষের বিপদে বিপর্যয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো ছিল তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। বিবেক ও রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে তিনি তাঁর কর্তব্য নির্ধারণ করতেন। উন্নত মানসিকতা ও দৃঢ়তা নিয়ে তিনি কাজ করতেন। এবং এজন্য চরম বিপদের সময়ও তিনি তাঁর নীতি ও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি। একাত্তরের সেই মৃত্যুভয়াল দিনে খুণী জল্লাদদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সবাই পালিয়েছিল। ডা. শামসুদ্দীনও হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের কারণে তিনি তা করেননি। আহত পঙ্গু, অসুস্থ রোগীদের অসহায়ভাবে ফেলে যেতে পারেননি তিনি। চিকিৎসাশাস্ত্র ও রেডক্রসের মহান আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ডা. শামসুদ্দীন বাঙালিদের পাশাপাশি আহত পাঞ্জাবী সৈন্যদেরও চিকিৎসা করেছেন। মহৎ হৃদয় ডা. শামসুদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেননি তাঁর প্রিয় ছাত্র ডা. শ্যামল কান্তি লাল, মেইল নার্স মাহমুদুর রহমান, এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার কোরবান আলীসহ আরো কয়েকজন। জল্লাদদের হাতে সবাইকে একই ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত।
হাসপাতালে যারা তাদের প্রিয় স্যার ডা. শামসুদ্দীনকে একা হাসপাতালে ফেলে যায়নি তাদের মধ্যে কয়েকজন নার্সও ছিলেন। তাদের মধ্যে ও.টি’র সিস্টার বরিশালের সংগীতা সরকার, স্টাফ নার্স গীতা বিশ্বাস, নীলা গোমেজ, বীথি, সিস্টার মোমেনাও ছিলেন। এদের নিরাপত্তার জন্য তাদের শামসুদ্দীন স্যার খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি তাদের বাড়িতে বা নিরাপদ কোন আশ্রয়ে পাঠাতে পারছেন না আবার হাসপাতালে রাখতেও ভরসা পাচ্ছেন না। তিনি গভীর আশ্বাস নির্ভর করলেন ন্যাপনেতা (পরে গণতন্ত্রী পার্টি, সিলেট-এর সভাপতি) আব্দুল হামিদের উপর। বিশ্বস্ত লোক মারফত চিঠি পাঠালেন কদমতলীতে হামিদ সাহেবের বাড়িতে। ছোট চিঠিতে লিখলেন আমার কাছে ৬টি মেয়ে আছে। এরা নন সিলেটী। আমি তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। যে ভাবেই পারেন তাদেরকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যান। ডা. শামসুদ্দীন শহীদ হবার দু’দিন আগে এই চিরকুট লিখেছিলেন।
ডা. শামসুদ্দীন আহমদের জীবনে একটি বড় প্রতিজ্ঞা ছিল। সেই ছাত্র জীবনে ডাক্তার হবার আগে তিনি শপথ করেছিলেন, তিনি সরকারি চাকুরী করবেন না। পরাধীন ভারতে ছাত্র জীবনে যাদের সাথে এক সঙ্গে রাজনীতির হাতে খড়ি নিয়েছিলেন সেই ঘনিষ্ট বন্ধু পীর হবিবুর রহমান ও তসদ্দুক আহমদও এই প্রতিজ্ঞায় সামিল ছিলেন। ডা. শামসুদ্দীন তখন আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের বড় নেতা। ১৯৪৬ সালে ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় আসামের গৌহাটিতে। সিলেট থেকে তিনবন্ধু এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিন বন্ধু মিলে এক চুক্তি করে শপথ নিয়েছিলেন, তারা সরকারি চাকুরী করবেন না। দেশ ও মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করবেন। তাদের বন্ধুমহলে এই শপথ গৌহাটি প্যাক্ট নামে অভিহিত হতো।
ডা. শামসুদ্দীন আহমদ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ঠিক আগে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার হয়ে বের হন। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ টগবগে যুবক ডাক্তার শামসুদ্দীন সরকারি চাকুরীতে যোগ দেননি। এসময় আগস্ট মাসে দ্বিজাতি নামক এক ভ্রান্ত তত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়। এসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ডাক্তারগণ ভারতে চলে যান এবং হাসপাতাল অচল হয়ে পড়ে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সিলেটে আগমন করেন। এসময় সিলেটের নেতৃবৃন্দ স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী তরুণ ডাক্তার শামসুদ্দীন আহমদ ও তাঁর অন্যান্য ডাক্তার বন্ধুদের চাকুরীতে যোগ দিয়ে মানুষের সেবার মাধ্যমে দেশসেবার আহবান জানান। চিকিৎসার জন্য মানুষের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে ডা. শামসুদ্দীন হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেন। পরে বিলেত থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে এসে তিনি ডাক্তারী তথা সেবাকার্যক্রমে বিরল নজির স্থাপন করেন। সারা চাকুরী জীবনে এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দেশ সেবা ও মানব সেবার মহৎ সংকল্পটি তিনি শুধু হৃদয়ে লালনই করেননি অক্ষরে অক্ষরে তা পালনও করে গেছেন। দেশ মাতৃকার দুর্যোগময় সময়ে নিজের জীবন দিয়ে তিনি তাঁর সংকল্পের মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
শৈল্য চিকিৎসায় ডা. শামসুদ্দীন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। শুধু চিকিৎসার জন্য তিনি যশস্বী ছিলেন না, চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবেও তিনি শীর্ষে ছিলেন। সাংগঠনিক কাজে তার দক্ষতার স্বাক্ষর রয়েছে ‘ইপমা’ গঠনে। ডাক্তারদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বি.এম.এ’র পূর্বসূরী পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশন তো তাঁর হাতেই গড়া। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে তিনি এই সংগঠনের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। মেডিকেল রিলিফ সংস্থা- পাকিস্তান এ্যাম্বুলেন্স কোর-এরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। বন্যা দুর্গতদের সাহাযার্থে ১৯৫৪ সালে ডা. শামসুদ্দীন আহমদের উদ্যোগে ও তৎপরতায় এই সংগঠন জন্ম লাভ করেছিল।
ইদানিং বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নামে দেশব্যাপী স্থানে স্থানে চক্ষুশিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই মহতী জনসেবামূলক কাজের প্রবর্তক হলের শহীদ অধ্যাপক ডা শামসুদ্দীন। কয়েকজন উৎসাহী ব্যক্তির সহযোগিতায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি ১৯৬৪ সালে সিলেটের মাদ্রাসা মাঠে সর্বপ্রথম চক্ষু শিবির অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন। একই বছর প্রতিষ্ঠিত জালালাবাদ অন্ধ কল্যাণ সমিতির তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। সিলেট য²া হাসপাতাল ও আম্বরখানা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূলেও ডা. শামসুদ্দীনের উদ্যোগী ভূমিকা ছিল।
ডা. শামসুদ্দীন আহমদ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতি বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ ও বুর্জোয়া রাজনীতিকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। সমাজের প্রতি, দেশে মানুষের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট ছিল। এই কমিটমেন্টের প্রতি তিনি আজীবন বিশ্বস্ত ছিলেন। উন্নত মানসিকতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও ব্যক্তিত্ব এই তিন গুণের বিরল সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মাঝে। এজন্য চাকুরী ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশে সর্বত্রই তিনি ছিলেন সম্মানিত। কোন প্রলোভন তো নয়ই, কোন ভয়-ভীতিও তাঁকে তাঁর আদর্শ, বিশ্বাস ও নীতি থেকে এতটুকু নড়াতে পারতো না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় ডা. শামসুদ্দীন আহমদের কর্মস্থল ছিল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ। এসময় ২০ জানুয়ারি। ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান এবং ১৫ ফেব্রæয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক ঢাকায় নিহত হন। এসবের প্রতিবাদে ১৮ ফেব্রæয়ারি রাজশাহীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-শিক্ষক-জনতার শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোতায়েন সেনারা শোভাযাত্রার উপর হামলা চালায়। তারা ডঃ শামসুদ্দোহাকে গুলি করে এবং বেয়োনেটের আঘাতে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। এই ঘটনায় জল্লাদ বাহিনী বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। তাই প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেবার লক্ষ্যে ঘাতক সেনারা সার্জারীর অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীনকে মিথ্যা-বানোয়াট পোস্টমর্টেম রির্পোট প্রদানের জন্য বলেছিল। দৃঢ় চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ডা. শামসুদ্দীন ঘাতকদের রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি। তিনি পোস্টমর্টেম রিপোর্টে গুলি ও বেয়োনেটের আঘাতের সত্য ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। সেদিনই হয়তো জল্লাদ গোষ্ঠী ডা. শামসুদ্দীন আহমদকে টার্গেট করে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত করে নিয়েছিল। এর দু’বছর পর ৯ এপ্রিল ঘাতকরা সিলেটে তাদের টার্গেট পূরণ করেছিল।
পাদটিকা : একাত্তরের সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি বর্তমানে সিলেট শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদ হাসপাতাল।
লেখক : সাবেক শিক্ষক ও কলামিস্ট।