হাসান শাহরিয়ার ও কিছু কথা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:২৮:০৮ অপরাহ্ন
হোসেন তওফিক চৌধুরী
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আনন্দ ও শোক-দুঃখ বাড়ে। তবে আনন্দের চেয়ে দুঃখের বোঝাই বেশি। আমি আমার জীবনে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সহ অনেক আপনজনকে হারিয়ে দুঃখের বোঝা বেয়ে চলেছি। ২০২১ সালের ১০ ই এপ্রিল আমার জীবনে অত্যন্ত শোকের দিন। ঐ দিন আমি আমার প্রাণ প্রিয় অনুজ হাসান শাহরিয়ারকে হারাই। সে আকস্মিকভাবে না ফেরার দেশে চলে যায়। আমরা শোক সাগরে ভাসি। তাঁর মৃত্যুতে আমি প্রচন্ডভাবে শোকাভিভূত হই। মুর্ষে পড়ি। কবির ভাষায় বলি ‘ভেঙ্গে গেছে মোর বুকের পাজর ছিড়ে গেছে বীণার তার এখন হৃদয় ভরিয়া উটিছে কেবল প্রবল হাহাকার’। এই দুঃখের বোঝা শেষ হবার নয়। সারা জীবন এই দুঃখকে সাথে নিয়েই বাঁচতে হবে।
আমি কখনও ভাবিনী শাহরিয়ার এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। চিরতরে হারিয়ে অনন্তের যাত্রী হবে। তাঁর মৃত্যুতে আমি হারালাম আমার আপনজন এবং অন্যান্যরা হারালেন এক কৃতি ব্যক্তিত্বকে। সে আমার কাছে ছিল ‘এক ফ্রেন্ড, গাইড ও ফিলসপার’। এটাছিল পারস্পরিক। সে বা আমি কখনও কিছু একে অন্যকে না জানিয়ে বা পরামর্শ করে করিনি। তাঁর মৃত্যুতে সর্বত্র গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মহান জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ১ম দিনের শোক প্রস্তাবে তাঁর নামে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। মাননীয় রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী তাঁর মৃত্যুতে শোকবাণী দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাস, ভারতিয় দূতাবাস, পাকিস্তানের দুতাবাস সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে। মিডিয়া তাঁর মৃত্যুতে সাংবাদিকতায় তাঁর অবদান সম্পর্কে গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছে। বিভিন্ন মসজিদে তাঁর রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা হয়েছে এবং বিভিন্ন সংঘটন শোক সভা করেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সুধিজনদের মধ্যে অনেকেই তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ লিখেছেন। বিলম্ব হলেও আমি আজ এই নিবন্ধে তাঁদের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই ।
শাহরিয়ারের জন্ম সুনামগঞ্জ শহরে। সুনামগঞ্জের আলো-বাতাসে তাঁর বেড়ে উঠা। হাজী মকবুল পুরকায়স্থ (এইচ.এম.পি.) এমই মাদ্রাসায় শিক্ষার হাতেকড়ি। পরে সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল থেকে ১৯৬২ সালে মেট্রিক পাশ করে সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়। এর আগে সে স্কাউটিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং সে লাহোর ও চট্টগ্রামের স্কাউট জাম্বুরিতে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করে সে করাচি চলে যায়। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স সহ এম.এ. ডিগ্রি লাভ করে। আমাদের পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন একজন পথিকৃত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি সিলেটের ‘যুগবাণী’, ‘যুগভেরী’, ‘সিলেট পত্রিকা’ এবং কলকাতার ‘দৈনিক ছোলতান’ পত্রিকার সম্পাদক। তিনি আসামের এম.এল.এ. ও পরিষদের হুইপ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস) ও সুনামগঞ্জ মহকুমা ঋণ সালিশি বোর্ডের চেয়ারম্যান। শাহরিয়ার তাঁর আদর্শেই বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয় এবং সুনামগঞ্জ থেকেই সাংবাদিকতা শুরু করে। সে সুনামগঞ্জ কচিকাচার মেলার সংঘটক ছিল। ইত্তেফাকের দাদাভাই রোকনুজ্জামান খানের সংস্পর্শে আসে। দাদাভাই তাকে সুনামগঞ্জ ইত্তেফাকের সংবাদদাতা নিয়োগ করেন। এই সময়ে সুনামগঞ্জে সুরমা নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা বের হতো। মোঃ আব্দুল হাই ছিলেন এর সম্পাদক। তিনি তাকে সুরমার কিশোর পৃষ্ঠার সাথি ভাই নিয়োগ করেন। এভাবেই সে সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করে। সে সুনামগঞ্জ কচিকাচার মেলার সংঘটক ছিল। সংঘটক হিসাবে সে অত্যন্ত কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করে।
শাহরিয়ার করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার হয়। এই সাথে সে করাচির ‘ইভনিং স্টার’ ও ‘ডিমক্রেট’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করে। করাচির ডন পত্রিকার সম্পাদক আলতাফ হোসেন একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ছিলেন সিলেটের এক পথিকৃত সাংবাদিক ও কৃতি সন্তান। তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। তিনি শাহরিয়ারকে ডনের রিপোর্টার নিয়োগ করেন। স্বীয় মেধা-প্রতিভা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমে সে সাংবাদিকতায় সুনাম অর্জন করতে শুরু করে। তাকে ঢাকার ইত্তেফাক করাচি সংবাদ দাতা নিয়োগ করেন। সুনামগঞ্জ থেকে তার সাংবাদিকতা শুরু এবং বিকশিত হয় করাচিতে। সে করাচি প্রেসক্লাবে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে শাহরিয়ার স্বদেশে ফিরে এলে ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক তাকে চীফ রিপোর্টার নিয়োগ করেন। আমি ঐ সময়ে অধুনালুপ্ত দৈনিক পূর্বদেশের সিনিয়র রিপোর্টার ছিলাম। পরে শাহরিয়ার ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি ও নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালনের পর অবসর গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামের ‘পিউপল ভিউ’ তাকে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নিয়োগ করে। সে আমেরিকার প্রখ্যাত ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’, মধ্যপ্রাচ্যের ‘খালিজ টাইমস’, ভারতের ‘ডেকান হেরাল্ড’ পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ছিল। সুনামগঞ্জ থেকে যার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি সে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। সে হয় বরেণ্য ও নন্দিত। সে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সাংবাদিকতায় উৎকর্ষতা প্রমাণ করে সাংবাদিকতায় এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
শাহরিয়ার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিল। বৈদেশিক সাংবাদিক সংস্থা (ওকাব) প্রতিষ্ঠিত হলে শাহরিয়ারকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শাহরিয়ার কমনওয়েল্থ প্রেস ইউনিয়ন (সি.জি.এ) দুই মেয়াদে সভাপতি ছিল। তাঁর আগে এশিয়ার আর কোন সাংবাদিক এই পদে অধিষ্টিত হন নাই। মৃত্যুকালে শাহরিয়ার এই প্রতিষ্ঠানের এমিরিটাস সভাপতি ছিল। সে দেশে সাংবাদিক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। সে সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস) ও সুনামগঞ্জ জগৎজ্যোতি পাঠাগারের আজীবন সদস্য ছিল। সে বাংলা একাডেমির ফেলো মনোনিত হয়। শাহরিয়ার একজন লেখক ও কলামিষ্ট ছিলেন। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে ‘অতীত অতীত নয়’, ‘যারে দেখতে নারী তার চলন বাকা’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এবং তারপর নিউজ উইকে বাংলাদেশ” অন্যতম। তার উপর একটি স্মারক গ্রন্থ বেরিয়েছে। বইটির নাম ‘সাংবাদিকতায় এক জীবন্ত কিংবদন্তী’। বইটি সম্পাদনা করেছেন ড. মিজানুর রহমান শেলি।
শাহরিয়ার অত্যন্ত ধার্মীক ছিল। সে একাদিকবার পবিত্র হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেছে। ইসলামিক জীবন যাত্রায় সে ছিল পাবন্ধি। সে প্রত্যহ পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করত। নামাজ রোজা করেছে। সে সকল আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে শাহরিয়ার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সে অনেকের চাকুরী পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। যে কেউ তাঁর সাহায্যের জন্য দারস্থ হয়েছে সে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। কাউকে বিমুখ করে নাই। এই হলো সংক্ষেপে শাহরিয়ার সম্পর্কে আমার অভিব্যক্তি। শাহরিয়ারের স্মৃতি দীর্ঘদিন মানুষের অন্তরে বিরাজ করবে-থাকবে মনের মণিকোঠায়। অনির্বাণ দীপশিকার মতো প্রজ্জলিত থাকবে। দোয়া করি আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট।