ইফতারির নামে জুলুমবাজি বন্ধ হোক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ২:৫০:০৯ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী:
পবিত্র রমজান মাসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোকেরা সিয়াম সাধনা করে সেহরি ও ইফতারের মাধ্যমে আলাদা একটা স্বাদ উপভোগ করে থাকেন। এই মাসে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য বেশি বেশি করে এবাদত করে থাকেন মুসলমানরা। এমনকি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে বছরের শ্রেষ্ঠ রজনী, ক্বদরের রজনী এই মাসের মধ্যেই রয়েছে, যে রজনীকে হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ রজনী বলে ঘোষণা করেছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। এই মাসেও অনেক মানুষ একটি অনৈতিক এবং কুপ্রথা পালন করে থাকেন যে, মেয়ের বাড়ি কার্টুন বোঝাই করে ইফতারি না-দিলেই যেন আর হয় না। এ বিষয়টি কতটুকু বৈধ সেদিকে আমি যাব না, আসুন এটি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত খানিকটা আলোচনা করে দেখি।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি কাউকে ইফতার করায় তাহলে সে-ও ওই রোজাদারের সমান সওয়াব হাসিল করবে, যদি সেই ইফতার শুধুমাত্র একটা খেজুর দ্বারাও হয়। এখানে কিন্তু মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ির লোকজনকে যদি করায় সে-কথা বলেননি। বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যদি যে-কেউ ইফতার করায় তাহলে সে ওই রোজাদারের সমান সওয়াবের অধিকারী হবে। এখন আসুন, আমাদের বর্তমান সমাজে প্রচলিত মেয়েদের বাড়ি ইফতারি দেওয়ায় সমাজের ক্ষতি কতটুকু হচ্ছে একটু পর্যালোচনা করি। মনে করুন, আপনি আপনার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন যে পরিবারে সেই পরিবারে আপনার মেয়ে ছাড়াও আরো দু’জন পুত্রবধূ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী পরিবারের একমাত্র আপনার মেয়ে। তাই আপনি খুব জাঁকজমকভাবে কার্টুন বোঝাই করে বিভিন্ন ফলমলসহ আধুনিক বস্তু দ্বারা ইফতারি পাঠালেন। আপনার মেয়ের পরিবারের লোকেরাও ইফতারি পেয়ে খুব আনন্দিত, পুরো গ্রামে বণ্টন করলেন এবং সবাই মিলে খেলেন। আপনার মেয়েও খুব আনন্দিত হল। কিন্তু আপনি কতটুকু সওয়াবের অধিকারী হলেন? এই ঘরে যে আরো দু’জন পুত্রবধূ আছে তাদের বাবার বাড়ির অবস্থা হয়তো সঙ্কটজনক, কোনোমতে দিন যাচ্ছে আর রাত পোহাচ্ছে। এখন আপনার মেয়ের কার্টুন বোঝাই ইফতারি দেখে তো তাদের মাথায় বাজ পড়েছে। আপনার মেয়ে খুব খুশি ঠিকই কিন্তু এই দুটি মেয়ে হাঁটছে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। আর আফসোস করছে নিজেদের দরিদ্রতার জন্য। পরবর্তীতে আপনার কার্টুন বোঝাই ইফতারির জন্যে হয়তো সেই মেয়েগুলো নিজের শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে অন্য চোখে থাকতে পারেন, হয়তো অনেক খোঁচাখুঁচি কথাও শুনতে পারেন। হয়তো কোনো সময় বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে গিলে বলতেও পারেন। বাবা হয়তো মেয়ের কথা শুনে, মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে অনেক দুঃখ-কষ্ট করে কিংবা ধার করে মেয়ের বাড়ি কোনোমতে একটু ইফতারি নিয়ে আসতে পারে যা হয়তো এই শ্বশুর-শাশুড়ির চোখেও লাগবে না। কারণ তারা তো আগে আপনার কাছ থেকে অনেক বড় বড় কার্টুন বোঝাই ইফতারি পেয়েছিল।
আপনি একটি বার চিন্তা করুন, সেই দুটি মেয়েও কি আপনার মেয়ের মত নয়? আপনি বলতে পারেন, আমার টাকাপয়সা আছে আমি দিয়েছি, তাদের বাবার টাকা নেই তাতে আমি কী করব! হ্যাঁ, আপনাকে করতেই হবে। কারণ আপনি কি এই সমাজে বসবাস করছেন না? না কি অন্য কোনো গ্রহে বাস করছেন? যদি আপনি এই সমাজে বাস করেন তাহলে প্রতিটি মানুষের সুখ-দুঃখে আপনাকে অংশীদার হতে হবে। আপনার টাকার জন্য আরেকটি মেয়ে যদি চোখের পানি ফেলে তাহলে অবশ্যই শেষ বিচারের দিন এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতেই হবে, কোনো সন্দেহ নেই। এই মেয়ের বাবার উপরে যে জুলুম হয়েছে সেজন্য সে মেয়ের স্বামীর ঘরের পাশাপাশি, আপনিও সমান দায়ী। শুধুমাত্র এই যে একটি পরিবারের দুটি মেয়ের উদাহরণ দিলাম, বাস্তবে তো আরো অনেকের উপর এ রকম জুলুম হয়ে থাকে।
এবার আসুন ছেলেদের ঘরে। ইফতার করানো অনেক সওয়াব। তাহলে ছেলেদের পক্ষ থেকে মেয়েদের বাবার বাড়ির লোকদের ইফতার করান না কেন? আপনিও তো চাইলে আপনার শ্বশুর-শাশুড়িকে ইফতার করাতে পারেন। আর যদি কোনো ছেলের পরিবার থেকে বলপূর্বক বা মেয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ইফতারি দিতে বাধ্য করানো হয় তাহলে মনে রাখবেন, ওই পরিবারের মতো জালিম আর কোনো পরিবার বর্তমান সময়ে নেই। ইসলাম তো এগুলো দিতে বলেনি। এরকম পবিত্র ইফতারির নামে অনৈতিকতা এবং কুপ্রথা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। এই কুপ্রথাগুলোর জন্য হাজার হাজার মেয়ের চোখের পানি অবাধে ঝরছে। অনেক মা-বাবা কেঁদে কেঁদে রাত পোহাচ্ছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগুলোকে বর্জন করি।
এদিকে বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য অসহায় হয়ে পড়েছে প্রায় মানুষ, অনেক মধ্যবিত্তের ঘরে পর্যন্ত আজ নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার নেই। তাই আসুন, আমরা মেয়েদের বাড়ি কার্টুন বোঝাই করে ইফতারি না-দিয়ে অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াই। আপনার পাশের ঘরে, পাশের বাড়িতে, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে খবর নিন, দেখবেন হয়তো অনেকেই অসহায় হয়ে আছে পরিস্থিতির কারণে, কিন্তু লজ্জায় কাউকে বলতে পারছে না। আর যদি আপনি খুঁজে বের করতে না-পারেন অসহায় কোন পরিবার তাহলে বিভিন্ন সংগঠন আছে এবং আমাদের কাছেও শত শত অসহায় পরিবারের লিস্ট আছে, আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
মনে রাখবেন, বিত্তশালী পরিবারে কার্টুন বোঝাই করে ইফতারি দেওয়ার চেয়ে অসহায় কাউকে এক বেলা পেট ভরিয়ে খাওয়াতে পারলে তাঁর যে দোয়া ও ভালোবাসা পাবেন, হয়তো আপনার সারাজীবনেও এমন দোয়া পাননি। এতে অবশ্যই অনেক সওয়াবের অধিকারী হবেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কথা হল, আপনি আমি যে-কেউ কোনো দরিদ্র বা অসহায় মানুষকে যদি সাহায্য করি তাহলে তা যেন অতি গোপনে করার চেষ্টা করি। সাহায্যের সময় কোনো ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত না-করার জন্য করজোড়ে আবেদন করছি। কারণ, সবারই আত্মসম্মান আছে। সহযোগিতার নামে কারো আত্মসম্মান নিয়ে খেলা করবেন না। হতে পারে সে গরিব বা পরিস্থিতি সাপেক্ষে দরিদ্র, কিন্তু সে-ও মানুষ। আসুন, আমরা সবাই এই বরকতময় মাসে বেশি বেশি করে যাদের প্রয়োজন তাদেরে সহযোগিতা করি। এক্ষেত্রে আমরা ধর্মের মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ না-থাকি।
লেখক : কলামিস্ট।