বাঙালির সর্বজনীন উৎসব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৫১:৫৫ অপরাহ্ন

শেখর ভট্টাচার্য :
মানুষের সাথে মানুষের মিলন ঘটায় উৎসব। উৎসব নিয়ে সব থেকে সুন্দর কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। উৎসব নিয়ে তার দার্শনিক বিশ্লেষণ হৃদয় এবং মস্তিষ্কে ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেইদিন।’ উৎসব নিয়ে তাঁর দার্শনিক ব্যাখ্যা উৎসবের তাৎপর্যকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে আমাদের। কী গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণ- ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ এদিন আমরা ব্যক্তিবিশেষ নই, মানুষ হিসেবেই নিজেকে জেনে ও সেভাবে প্রকাশ করে ধন্য হই। ‘এই নিজেকে জেনে’ নিজেকে উজাড় করে প্রকাশ, তা’ উৎসবের আয়োজন নিশ্চিত করে দেয়।
নিজেকে জানার বিষয়টির কথা গুরুত্ব দিয়ে বলা শুরু করেছিলেন দার্শনিক সক্রেটিস। সক্রেটিস যখন ‘নিজেকে জানার’ বিষয়ে আহব্বান জানিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপট ছিলো ভিন্ন। তিনি সমগ্র মানব জাতিকে অন্তরের আলো অনুসন্ধান করার উদ্দেশ্যে বলেছিলে। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যও এক। তিনিও জাতি হিসাবে বাঙালিদের অন্তরের ভেতর থেকে প্রাণের প্রদীপ জ্বলানোর উদ্দেশ্যে দাররশনিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। একক মানুষ উৎসব উপলক্ষে মেল বন্ধনের সুযোগ পায়। এ বন্ধন দৃঢ়তর করে উৎসব। বন্ধন দৃঢ় হলে একক মানুষ বৃহৎ রূপ ধারণ করে। মানুষ আলোকিত হয়। মানুষ তার মনুষ্যত্ব শক্তি অনুভব করার শক্তি অর্জন করে মহৎ হয়ে ওঠে। মানুষ ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে ওঠে।
জাতি হিসাবে বাঙালি নিজেদেরকে জানা শুরু করেছিলো তার ভাষা এবং সংস্কৃতির আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। এসময়েই বাঙালি তার নববর্ষকে বিশেষ ভাবে জেনেছিলো। ষাটের দশকে বাঙালির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে শুরু হওয়া এই বর্ষবরণ নাম ধারণ করে পহেলা বৈশাখ হিসেবে। ১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়। একসময় বাংলা নববর্ষ ছিল মূলত কৃষিসমাজের গ্রামীণ আয়োজন। কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য, আর ছেলে ভুলানো খেলা ও খাওয়ার সামগ্রী নিয়ে গ্রামীণ মেলা। পাঁচের দশক থেকে শুরু হল ছোট ছোট শহুরে আয়োজন, তা একটা নাগরিক সাংস্কৃতিক আয়োজনের রূপ পেলো ছায়ানটের উদ্যোগের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে এ উৎসব শহর ও গ্রামে ছড়িয়েছে। এককালের গ্রামীণ আর বর্তমান কালের নাগরিক মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক এ উৎসব বর্তমানে সারা দেশে অরাজনৈতিক সামাজিক উৎসবে রূপ নিয়েছে।
ছায়ানট যখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের রক্ষচক্ষু উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপন শুরু করেছে গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায়, তখন সারা দেশে এটিই ছিল বাংলা বর্ষবরণের উল্লেখযোগ্য প্রভাতী অনুষ্ঠান। কিন্তু নাগরিক মানুষ নববর্ষ উদযাপন ও উপভোগ করেছে, অংশ নিয়েছে এবং অনুপ্রাণিত হয়েছে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই।ছায়ানট একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছিলো রমনার বটমূলের অনিন্দ্য সুন্দর আয়োজনের মাধ্যমে। সে প্রদীপের অগ্নি শিখার প্রভাবে লক্ষ লক্ষ সেঁজুতি জ্বলে উঠেছে ক্রমান্বয়ে দেশের কোণায় কোণায়। ছায়ানটের অনুষ্ঠানের আদলে নিজেদের কৃষ্টিকে ভালোবেসে দেশের অসংখ্য জায়গায় ধীরে ধীরে নববর্ষের প্রভাতী সঙ্গীতানুষ্ঠান চালু হয়। এভাবে গ্রামীণ উৎসব ও নাগরিক আয়োজন এক বিন্দুতে এসে মিলে যায়।
জাতি হিসাবে বাঙালির হাতে হাত রেখে আয়োজন করার মতো উৎসবের সংখ্যা খুব বেশী নেই। অন্তরকে ছোঁয়া আলিঙ্গনের মাধ্যমে উদযাপন করার মতো সর্বজনীন উৎসব দিয়ে সংহত হওয়ার বড় প্রয়োজন ছিলো বাঙালির। বাঙালি খুঁজে ফিরছিলো এমন একটি উৎসবের যে উৎসব ধর্মনিরপেক্ষ, অসা¤প্রদায়িক এবং সর্বজনীন। যে উৎসবের মাধ্যমে অন্তরকে আলোকিত করা যায়। দুই ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা হল ধর্মীয় উৎসব- মুসলমান ও হিন্দু সীমিতভাবে এ সময়ে পরস্পরের সাথে লৌকিকতা বা সৌহার্দ্য বিনিময় করলেও তা কখনও ধর্মীয় গÐি পুরোপুরি ভাঙতে পারেনি, নানা কারণে। যতোটুকু বৃত্ত ভাঙ্গে তা’নিয়ে একদল মানুষ কোলাহল, বিতর্ক সৃষ্টি করে।তারা প্রচারণা করে ধর্ম এবং উৎসব শুধু আমার ‘আমাদের’। যদিও মুক্ত মনে এগিয়ে এসে সকলেই উৎসবের আনন্দে সামিল হতে পারে এবং অধিকাংশ মানুষকে আমরা পরস্পরের উৎসবে সামিল হতেও দেখি তার পরেও মিলনের পথে কাটা বিছিয়ে দেয় কিছু মানুষ পবিত্র ধর্মের নাম নিয়ে।
নববর্ষকে আমরা আমরা যতোই অরাজনৈতিক, অসা¤প্রদায়িক অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করি, ধর্মীয় রাজনীতি যারা করেন, যারা মানুষের অন্তরের ভেতরে সা¤প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে দিতে চান তারা ধর্মের সাথে সম্পর্কহীন এই অসা¤প্রদায়িক উৎসবের গায়ে সব সময় ধর্মের রঙ চড়াতে প্রস্তুত থাকেন। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সকলের কাছে গ্রহণ যোগ্য, সেই সুন্দরকে যদি আমরা কালিমা লিপ্ত করি সা¤প্রদায়িকতার নামে তাহলে জতীয় ভাবে আমরা কৃষ্টিহীন, ঐতিহ্যহীন হয়ে পড়বো দ্রæত। সুন্দরই সত্য সত্যই সুন্দর, আমরা যদি সুন্দরকে পরিত্যাগ করি তাহলে সত্যকে পরিত্যাগ করবো এ’কথাটি অন্ধ মানুষদের কে বুঝাবে।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো মঙ্গল শোভা যাত্রা। ১৯৮৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের হতাশার দিনগুলোতে তরুণেরা এটা শুরু করেছিল। শিক্ষার্থীরা অমঙ্গলকে দূর করার জন্য বাঙালির নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, প্রাণির প্রতিকৃতি ও মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রা করে। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমোদন করে ইউনেস্কো লিখে: ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা হল জনসাধারণের একটি উৎসব যা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে (নববর্ষের দিনে) উদযাপন করা হয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দ্বারা আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যটি ১৯৮৯ সালে শুরু হয়, যখন সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসরত হতাশ শিক্ষার্থীরা স¤প্রদায়কে একটি উন্নত ভবিষ্যতের আশা দিতে চেয়েছিল। এটির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে মুখোশ ও ভাসমান প্রতিকৃতি যা শক্তি, শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অশুভ কে দূরে সরানোর প্রতীক।
মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরও যে কয়েকটি কারণ ইউনেস্কো উল্লেখ করেছে তা হচ্ছে, এই শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়। সমগ্র বিশ্ব যা অনুধাবন করতে সক্ষম হলো, আমাদের অন্তরের প্রসারতা দিয়ে আমরা তা’ উপলব্ধি করতে এখনো দ্বিধাবোধ করছি। স¤প্রতি মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করার জন্য একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশটিতে নানা ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা মূলত একটি ধর্ম বিরোধী আয়োজন। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সকল ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে। যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন। অপরদিকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা হচ্ছে এবং ইসলাম ধর্মকে অপমান করা হচ্ছে যা দÐবিধির ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।বাংলা বর্ষবরণ উৎসবের নান্দনিক এই আয়োজনকে অসাংবিধানিক, বেআইনি উল্লেখ করে অবিলম্বে তা বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। নইলে সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করার কথা বলা হয়েছে নোটিশে।
উৎসব নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে লেখাটির সূত্রপাত ঘটানো হয়েছিলো। আমরা জেনেছিলাম উৎসব মানুষের ভেতরের মানুষকে বৃহৎ করে, হৃদয়ের গহীনে থাকা অন্ধকারকে দূর করে মহৎ করে। মানুষ প্রগতির দিকে এগিয়ে যায়। বাংলা নববর্ষ পালন আইয়ুব খানের আমলে এতো কন্টকাকীর্ন ছিলোনা। জাতীয়তাবাদ নিয়ে সাতষট্টি সালের পর আর কেউ প্রশ্ন তুলেনি। আমরা যেদিন জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে বিভাজিত হলাম তার পর থেকেই উল্টো পথের যাত্রী হয়েছি। সা¤প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়া, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ছায়া এড়িয়ে যেতে না পারলে আমাদেরকে একই বৃত্তে আবদ্ধ থাকতে হবে। এ’ক্ষেত্রে তরুণরাই আমাদের ভরসা। নববর্ষের অন্তর্নিহিত বাণীকে উপলব্ধি করে তারাই পারবে সকল বাঁধ ভেঙ্গে আবাহমান সংস্কৃতি চর্চার পথকে কন্টক মুক্ত করতে। নববর্ষের নুতন সূর্যোদয় হোক তরুণ সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক।