গরীবের ডাক্তার মঈন উদ্দিন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৫৪:৫৪ অপরাহ্ন
মো. জিয়াউল হক :
শহীদ ডা. মঈন উদ্দিনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী কাল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান করোনার সম্মুখ সমরের এই সাহসী যোদ্ধা। কিছু মানুষের ঠিকানা শুধু জমিনে হয় না, হয় হাজারো মানুষের অন্তরে। ডা. মঈন উদ্দিন তাদের অন্যতম। ছাতক তথা সারা সিলেটবাসীর কাছে যিনি ‘গরীবের ডাক্তার’ নামে পরিচিত। ছিলেন এলাকার চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় মানুষ।
করোনাকালের প্রথম দিকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর খবরে কেবল তার জন্মস্থান ছাতক নয়, সিলেটের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
তিনি ছিলেন এক মানব দরদী চিকিৎসক। সর্বমহলে তিনি ‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার বাবা মুনসী আহমদ উদ্দিন ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। মৃত্যুর আগে ছেলেকে বলেছিলেন, এলাকার অসহায় রোগীদের যেন নিয়মিত সেবা দেন । বাবার সেই কথা রেখেছেন ডা. মঈন উদ্দিন। প্রতি শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকের নাদামপুরে ছুটে আসতেন তিনি। বিনামূল্যে গরিব অসহায়দের ব্যবস্থাপত্র দিতেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পও করেছেন তিনি।
ডা. মঈন উদ্দিন ১৯৭৩ সালের ২ মে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নাদামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি ধারণ নতুন বাজার উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি এবং ১৯৯০ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই বছর ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর তিনি এফসিপিএস ও এমডি কোর্স সম্পন্ন করেন।
২২তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ স্বাস্থ্য ক্যাডারে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের ২০ মে তিনি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
মঈন উদ্দিন চাচার মৃত্যুর আগে আমাদের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার ছিল আমাদের গ্রাম তথা আশেপাশের এলাকার মানুষের কাছে ঈদের দিনের মতো। প্রতি শুক্রবার নিজের বানানো বাংলোতে বসে এলাকার চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন। ১০০-১৫০ রোগীকে চিকিৎসা দিলেও কখনো চাচা মুখে বা কথার মাঝে একটু ও বিরক্তির ছাপ পড়ত না। ঈদের সময় বাড়িতে গেলে যেখানে সবাই ঈদের আনন্দে মশগুল, সেখানে এই মানুষগুলোকে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার মধ্যেই যেন চাচা প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পেতেন।
শুধু যে ওনার উদারতা চিকিৎসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। এলাকায় প্রতি রমজান মাসে ফ্রি কোরআন বিশুদ্ধকরণ কোর্স চালু করা এলাকায় যেসব ছেলে মেয়েরা অর্থের অভাবে পড়ালেখা করতে পারেনি তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করা, কারো ঘর বাড়ি মেরামতের ব্যবস্থা করা কারো আবার ছেলে বিদেশ যাবে কারো মেয়ের বিয়ে হবে, সব কাজের জন্য তিনি মানুষের কাছে ছিলেন আশ্রয়স্থল। মঈন চাচা ছিলেন গোপনে দানশীল একজন ব্যক্তি। গোপন দান তিনি খুব বেশি পছন্দ করতেন। তাই তো তার মৃত্যুর পরে জাতীয় সংসদ এ শোক প্রস্তাব বিল পাশ হয়। শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি সংসদের স্পীকার মন্ত্রী আমলা থেকে সবস্থরের মানুষ। মঈন চাচার মৃত্যুর পরে আজও তাঁর জন্য আমাদের গ্রামের হাজারো মানুষ কান্না করে। ওনার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এতটাই প্রবল ছিল যে চাচার মৃত্যুর পর সুদূর দিনাজপুরে ওনার এক বন্ধুর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে ডা. মঈন উদ্দিন স্কুল ভবন। সিলেট সিটি কর্পোরেশন ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কয়েস লোদীর উদ্যোগে গড়ে উঠে ডা. মঈন উদ্দিন জগিং ক্লাব। ওনার আরেক বন্ধু ডা.আশরাফ নিপু স্যারের মাধ্যমে একটা গাড়ি গরীব অসহায় মানুষের খাবার বিতরণের জন্য দেওয়া হয়।
ডা. মঈন উদ্দিন সিলেটে করোনা যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা ছিলেন। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের উদ্যোগে গঠিত সিলেট করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। এর আগে তিনি এ হাসপাতালের ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটিসহ আরো কয়েকটি কমিটির দায়িত্ব পালন করেন।
পরিশেষে বলব আমাদের সকল ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ডা.মঈন উদ্দিন চাচা চলে গেছেন আসমান ও জমীনের বিস্তৃত জান্নাতের দিকে, যেখান থেকে কেউ আর কখনোই ফিরে আসে না।
আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান করুন এই কামনা রইল।
লেখক:শিক্ষার্থী