সিলেটে বর্ষবরণে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ৩:৩১:৪০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাশিত অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে সারা দেশের মতো সিলেটেও উদযাপিত হলো ১৪৩০ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ।
দিনটিকে ঘিরে সিলেটে ছিলো নানা আয়োজন। জীর্ণ পুরাতন আর অসুন্দরকে পেছনে ফেলে সকল ধর্মের, সকল বর্ণের বাঙালি আবাহন করেছেন নতুনকে। লোকায়ত জীবন আর নিজস্ব কৃষ্টির কাছে মিলিত হয়েছেন সবাই। একই সাথে ধর্ম, গোত্র ভেদাভেদ ভুলে, স¤প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রিয় স্বদেশ গড়ার শপথ নিয়েছে তারা। মাহে রমজান উপলক্ষে সিলেটে সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠান হলেও উৎসবের কমতি ছিলো না।
সকাল থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানের। প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন সংগঠনও এই উৎসবে অংশ নেয়। এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আবহমান বাংলার চিরায়ত সম্প্রীতির মেলবন্ধন। পৃথক অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মধ্যে এই স্বজাত্যবোধ ও বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এই শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়েছে।
এদিকে, বর্ষবরণকে ঘিরে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি ছিল শহর ঘিরে। যার ফলে পূর্বঘোষিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয় প্রতিটি আয়োজন।
শ্রæতি : সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রæতির উদ্যোগে বরণ করে নেয়া হয়েছে বাংলা নতুন বছরকে। শুক্রবার বøু-বার্ড স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণে স‚র্যোদয়ের পর পরই শুরু হয় অনুষ্ঠান। এবছর শ্রæতি সম্মাননা ১৪২৯ বাংলা পেয়েছেন বরেণ্য নজরুল সংগীত শিল্পী শারমিন সাথী ইসলাম ময়না ।
অর্ধ দিবসব্যাপী শ্রæতির আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার দেবজিৎ সিনহা। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংগঠক ভবতোষ বর্মণ রানা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য শামসুল আলম সেলিম, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত, শ্রæতি সমন্বয়ক সুমন্ত গুপ্ত। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শ্রæতির সদস্য সচিব সুকান্ত গুপ্ত।
সাংস্কৃতিক পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশন সিলেটের সহকারী হাই কমিশনার নিরাজ কুমার জয়সওয়াল, সাধারণ সম্পাদক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী। সমবেত সংগীত এবং নৃত্য পরিবেশন করে অনুষ্ঠান আয়োজক শ্রæতি, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ সিলেট, গীতবিতান-বাংলাদেশ, সংগীত নিকেতন, ছন্দনৃত্যালয়, সুরের ভুবন, নৃত্যসুধা, ললিত মঞ্জরী, পাঠশালা, নৃত্যশৈলী, নৃত্যরথ প্রমুখ। একক সংগীত পরিবেশন করেন পার্থ প্রদীপ মল্লিক, খোকন ফকির, ইকবাল সাঁই, লিংকন দাশ, সোনিয়া রায় প্রমুখ।
সমাপনী আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় দুপুর ১২টায়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ ইলিয়াছ শরীফ পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদ রানা। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শ্রæতি বর্ষবরণ উৎসবের ষোড়শতম আয়োজন সমাপ্ত হয়।
আনন্দলোক : ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়’- এ আহবানে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘আনন্দলোক’ আয়োজন করেছে বর্ষবরণ উৎসব। এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৩ যুগে পদার্পণ করলো আনন্দলোকের বর্ষবরণ উৎসব। নগরীর কেওয়াপাড়াস্থ শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজ প্রাঙ্গণে এবারের উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস।
উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করেন আনন্দলোকের পরিচালক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রানা কুমার সিনহা।
উৎসবে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান, ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার নিরাজ কুমার জয়সওয়াল, কবি গবেষক এ কে শেরাম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আল আজাদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল আলম সেলিম, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত। অনুষ্ঠানে সংগীত-নৃত্য পরিবেশন করে বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা সিলেট শাখা, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সিলেট, নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ সিলেট বিভাগ, গীতবিতান বাংলাদেশ, সুরাঞ্জলি, চারুবাক ও নৃত্যশৈলী। বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী নন্দিতা দত্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠান সমন্বয়ে ছিলেন আনন্দলোকের সমন্বয়ক রবিকিরণ সিংহ রাজেশ।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় : সিকৃবি প্রতিনিধি জানান, বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ বরণ করে নিয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি)। শুক্রবার সকালে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ জামাল উদ্দিন ভ‚ঞার নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সম্মুখ থেকে শুরু হয়ে প্রধান ফটক হয়ে বৈশাখী চত্ব¡রে এসে শেষ হয়।
শোভাযাত্রা শেষে সহকারী প্রক্টর কিশোর কুমার সরকার সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডা. মোঃ জামাল উদ্দিন ভ‚ঞা। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা সামছুজ্জামান, অতিরিক্ত পরিচালক শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোঃ শাহ আলমগীর, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মনিরুল ইসলাম, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, শিক্ষক, কর্মকর্তা, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ ।
স্কলার্সহোম : স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহে নানা আয়োজনে পয়লা বৈশাখকে উদযাপন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মুনীর আহমেদ কাদেরী (অব.)।
১৪ মার্চ জাতীয় সংগীত ও বর্ষবরণের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গান দিয়ে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে ম‚ল প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রভাষক সৈয়দ হাসান মাহমুদ। প্রভাষক কামরুল হক জুয়েলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন স্কলার্সহোম শাহী ঈদগাহ ক্যাম্পাসের উপাধ্যক্ষ আশরাফ হোসেন চৌধুরী। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন বাংলা বিভাগের প্রভাষক সালমা খাতুন ও সার্বিক সহযোগিতা ও সংগীত পরিবেশনার কুশীলব হিসেবে কাজ করেছেন আইসিটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জাহিদুল ইসলাম। এছাড়াও বৈশাখের ছড়া, কবিতা, গানে অংশ নেন শ্রæতি কথা দাস, বিশ্বরূপ সাহা মানব, রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী, দীপিকা সেন প্রমুখ।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ : সিলেটে বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদের উদ্যোগে গত শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে বরণ করা হয়েছে নতুন বছরকে।
বৈশাখের আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বরুণময় চাকমা, তপন কান্তি বড়ুয়া মান্না, সাধন কুমার চাকমা, অধ্যাপক বরন চৌধুরী, শিমুল মুৎসুদ্দী,পলাশ বড়ুয়া, দিলু বড়ুয়া, তমাল বড়ুয়া, উৎফল বড়ুয়া, বেবী রানী বড়ুয়া, দিপ্তী বড়ুয়া, তপতী বড়ুয়া তপু, রমা বড়ুয়া, টুম্পা বড়ুয়া, রতœা বড়ুয়া, তানিন বড়ুয়া, শেলু বড়ুয়া, অতিথি শিল্পী সোমা বড়ুয়া, শিক্ষিক শিমলা বড়ুয়া নৃত্য শিল্পী অর্চি ও অথৈয় প্রমুখ।
জালালাবাদ গ্যাস : বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সিলেট জেলা প্রশাসন আয়োজিত মঙ্গল শুভাযাত্রায় জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিসন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড মঙ্গল শুভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে।
শুক্রবার সকালে শোভাযাত্রা সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে গিয়ে শেষ হয়। এসময় শুভাযাত্রায় সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
চারণ : চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে বিভিন্ন আয়োজনে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে ছিলো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শুক্রবার সকাল ১০টায় সিলেট চৌহাট্টাস্থ ভোলানন্দ নৈশ স্কুল প্রাঙ্গণে আলোচনা সভায় চারণ সিলেট জেলা আহবায়ক নাজিকুল ইসলাম রানা’র সভাপতিত্বে ও চারণ জেলা সদস্য মাসুদ রানা’র পরিচালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাসদ সিলেট জেলা আহবায়ক আবু জাফর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সিলেট জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল আলম সেলিম, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ। আলোচনা সভার পূর্বে ৩টি বিভাগে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সকাল সাড়ে ১০টায় পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রা শেষে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। সাংস্কৃতিক পর্বে শুরুতে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট জেলা শাখার শিল্পীরা গান-আবৃত্তি-নৃত্য পরিবেশন করে। আমন্ত্রিত সংগঠন হিসেবে পরিবেশনায় অংশ নেয় অনির্বাণ শিল্পী সংগঠন ও ছন্দনৃত্যালয়। অতিথি শিল্পী বিজন রায়ের একক সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক পর্বের সমাপ্তি হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান করা হয়