রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩২:৪৫ অপরাহ্ন
ব্রজেন্দ্র কুমার দাস:
এটাই সত্য যে, আমরা অনেকেই সব সময় সত্য তথা সত্য কথা বলি না। বলতে সাহস পাই না। আমরা কেউ ইচ্ছে করেই সত্য বলা থেকে বিরত থাকি। কখনও কখনও নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার কারণে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করে থাকি। সেটা হতে পারে ব্যক্তিগত পারিবারিক কখনোবা বৈশ্বিক বা রাষ্ট্রীক। কিন্তু সত্য সব সময় সত্যই। সেটা যুগে যুগে কালে কালে। এই সত্য প্রসঙ্গে বিশ্ব কবির একটি উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিক এবং শিক্ষণীয়ও বটে। এ প্রসঙ্গে তাইতো তিনি বলেন, ‘সত্যের লজ্জা নাই, ভয় নাই ভাবনা নাই। সে নিজেকে প্রকাশ করে, নিজেকে প্রকাশ করা ছাড়া তার আর গতি নাই; এই জন্য সে বেপরোয়া।’
সত্য যে বেপরোয়া এর যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় ২২.৩.২০২৩ তারিখের দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় প্রকাশিত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। তিনি কোন প্রকার রাখ ঢাক না করেই অকপটে সত্যকে শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে গরুর রাখাল হতাম’। সম্মানিত পাঠককুলের সুবিধের জন্য খবরটির সবকিছু বিস্তারিত তুলে ধরলাম। খবরটি হলো, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেছেন, “বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমি কাদের সিদ্দিকী গরুর রাখাল হতাম, রাজনীতিতে এসে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম, তাকে ভালোবেসে দেশের মাটি, গাছপালাকে ভালোবাসতে শিখেছি। দেশের মাটি আমার কাছে মায়ের মতো। মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমি কোথায় যেতাম, কি করতাম জানি না। মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাকে অনেক বড় ভাবেন, অনেক প্রশংসা করেন। আমি বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধে আমার কোন ভূমিকা নেই, কোন অবদান নেই। আমি পাকিস্তানিদের দেখে ভয় পাইনি, পালিয়ে যাইনি- এটাই আমার গুণ”। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের হুশিয়ারি দিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘আজ আমার কাছে একটি অভিযোগ এসেছে- বন বিভাগের কর্মকর্তারা নাকি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। এটা যদি আমি প্রমাণ করতে পারি তবে আপনাদের টাঙ্গাইলের সীমানা পার হতে দেওয়া হবে না। আপনারা সখীপুরের মানুষকে চেনেন না, পাকিস্তানিরাও বড় বড় কথা বলেছিল, ফলে তাদের হাত-পা গুটিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল।’
এখন প্রশ্ন হলো, জনাব কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্য থেকে আমরা কি বার্তাটি পেলাম?
আমার মনে হয় সে বার্তাটি হচ্ছে- দিবালোকের মতো সত্য এবং বাস্তবতাকে অকপটে স্বীকার করে নেবার সাহস আর মানসিকতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যে কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম খেতাব পেলেন তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ঋদ্ধ চিত্তে বলতে পারলেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে তিনি গরুর রাখাল হতেন। এই সমাজ আর দেশের ক’জন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি এমন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারি? বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে তো ’৭১ সালের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধই হতো না। যদি মুক্তিযুদ্ধ না হতো তাহলে এই বীর বিক্রম, বীর উত্তম বা বীরশ্রেষ্ঠ ইত্যাদি খেতাব পাবারওতো কোন সুযোগ হতো না বা সুযোগও ছিল না। আজকে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, পুরো পাকিস্তান আমলটি আমরা যারা দেখেছি এবং আজও বেঁচে আছি আমরা তো দেখেছি সে সময়ের বাস্তব পরিস্থিতি। সে সময় দেশের পুলিশ সহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন কি বাঙালি? ব্যাংকের তথাকথিত বড়কর্তা ছিলেন কি বাঙালি? ক্যাশিয়ার-কেরানী-পিয়ন-দারোয়ানের পদ নিয়েইতো পরম খুশি থাকতে হতো। এসি-ডিসি-জজ-ম্যাজিস্ট্রেট-বিচারপতি ইত্যাদি ক’জন ছিলাম পাকিস্তানে? বীর উত্তম পদের সিদ্দিকী যদি গরুর রাখাল হতেন বলে স্বীকার করেন তাহলে অন্যরা আমরা কি হতাম তা কি একটিবারও কেউ ভেবে দেখেন? কৃতজ্ঞতাবোধ বিবর্জিত মনমানসিকতার কারণে আমরা অনেকেই তা বেমালুম ভুলে যাই। কিন্তু এক্ষেত্রে চরম সত্য কথাটি হলো বঙ্গবন্ধু কিন্তু তাঁর জীবনের একটি মুহূর্তের জন্যও বাঙালি তথা আমাদের কারো কথাই ভুলে যাননি। বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্টে বসেও ভুলতে পারেননি তাঁর ‘ভায়েরা আমার’দেরকে। কিন্তু হায়! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস- তাঁর ভায়েরাই তাঁর এবং তাঁর স্বজনদের রক্ত দিয়ে রক্ত¯œান করলো! তবে এটাও সত্য যে, বাংলার গরুর রাখালরাই ছিলো তাঁর প্রাণের প্রাণ এবং এই জন্যেই তো বঙ্গবন্ধু বাংলার রাখাল রাজা। এমনি রাখাল রাজা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।
জনাব কাদের সিদ্দিকী আবেগ-তাড়িত কন্ঠে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমি কোথায় যেতাম, কি করতাম জানি না।’ কাদের সিদ্দিকী যদি এমন কথা বলতে পারেন তাহলে টাঙ্গাইলের বনবিভাগের কর্মকর্তারা কি বলবেন। তাদের উদ্দেশ্যে বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকীর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলছি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এদেশে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ হতো না। জন্ম হতো না মুক্তিযোদ্ধাদের। আর আজকের বন বিভাগের কর্মকর্তাদের তাদের মুনিব পাকিস্তানিরা তাদেরকে বন বিভাগের গাছের ঝরা পাতা কুড়াতেও নিত না। আর আপনারাই কিনা একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছেন। এটাতো তোমাদের মায়ের গায়ে হাত তুলার সামিল। মায়ের গায়ে হাত তুলে যারা তারা তো কুলাঙ্গার। গরুর রাখালের হাতের লাঠির শক্তি কতো তা দেখেছে পাকিবাহিনী, তোমরা তো কোন ছাড়!
এমনি অবস্থায় শুধু বন বিভাগ কেন, সব বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে বলছি- বঙ্গবন্ধু বাংলার রাখাল রাজা, মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী সন্তানেরা রাখাল রাজারই সন্তান। সন্তানের অপমানে কেঁদে ওঠে পিতার প্রাণ। পিতাকে কাঁদায় যেজন সেতো কুলাঙ্গার। কুসন্তান, অতএব সাধু সাবধান। জয় বাংলা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।