শবে ক্বদর তালাশ করতে হয়
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৩৭:৪০ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ ছয়েফ উদ্দিন
প্রতিটি কাল (সময়) সমান নয়। প্রতিটি স্থানও সমান নয়। এ জগতে বহু স্থান (জায়গা) রয়েছে, মানব জীবনে যার গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহাসিক এসব স্থানের নেপথ্যে মানব সভ্যতার বহু স্মৃতি বিজড়িত। ধর্মাবলম্বীরা এসব স্থানকে পুণ্যভূমি বা তীর্থস্থান হিসেবে মনে করে থাকেন। মক্কা, মদীনা, জেরুজালেম ইত্যাদি মুসলমানদের তীর্থস্থান। গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, কামরূপ ইত্যাদি হিন্দুদের তীর্থস্থান। ব্যাতেলহাম খ্রিস্টানদের তীর্থস্থান। তাছাড়া মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ইত্যাদি স্ব স্ব ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য। সুতরাং ভূ-পৃষ্ঠের সকল স্থানের মর্যাদা এক ও অভিন্ন নয়। একইভাবে মহাকালের সকল সময় (দিন, ক্ষণ ইত্যাদি) এক ও অভিন্ন নয়। ঈদের দিন, বড়দিন, পূঁজোর দিন ইত্যাদি স্ব স্ব ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মহাকালের এসব বিশেষ দিন, ক্ষণ (সময়টুকো) মানব জীবনে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এসব মর্যাদাপূর্ণ সময় মানুষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনা, এবাদত আরাধনা কিংবা ফূর্তি আমোদ করে থাকেন।
মুসলমানদের জীবনে এ ধরনের একটি নিশি হলো ‘শবে ক্বদর’। ইহা এক মহিমান্বিত রজনী। এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবে ক্বদর লুকায়িত রয়েছে। শেষ দশকে পাঁচটি বিজোড় রাত রয়েছে। পাঁচ রজনীর যেকোনোটিতে শবে ক্বদর থাকতে পারে। বেশির ভাগ ইসলামিক স্কলারদের মতে সাতাশ রমজানের রাতই শবে ক্বদর। এ মতবাদ সতসিদ্ধ কিংবা শতভাগ নিশ্চিত নয়। প্রকৃতপক্ষে কোন রজনীতে শবে ক্বদর লুকায়িত রয়েছে, মানুষ তা জানে না। কেবল মহান আল্লাহপাকই ভালো জানেন। রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় সবকটি রাতে শবে ক্বদর তালাশ (অনুসন্ধান) করতে হয়। ইহা তালাশের অন্যতম পন্থা এতেক্বাফ করা।’ ‘এতো গুরুত্বপূর্ণ রাতের সময়কাল আল্লাহপাক কেনো আমাদের মাঝে গোপন করে রেখেছেন?’ প্রশ্ন করাটা স্বাভাবিক। আল্লাহপাক অনেক কিছুই আমাদের কাছে গোপন রেখেছেন। যেমন- মৃত্যু। প্রতিটি মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। তবে মৃত্যুর দিন, তারিখ ও সময় আমাদের অজানা। মৃত্যুভয় মানুষের মনে ইবাদতের প্রবণতা সৃষ্টি করে। আল্লাহ পাক জ্বীন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন কেবলমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য। আল্লাহ পাক চান, বান্দা বেশি বেশি তাঁর ইবাদত করুক। শবে ক্বদর গোপন রেখেছেন, যেন বান্দা ইহা অনুসন্ধান করে চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে। বান্দা যেন রমজান মাস ব্যাপী আল্লাহপাকের ইবাদত করে। এ জন্য বান্দার চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে প্রাপ্য শবে ক্বদরের ইবাদত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
আগেকার নবী-রাসুলগণের উম্মতের জীবদ্দশায় শবে ক্বদর ছিল না। তাঁদের আয়ুষ্কাল ছিল দীর্ঘ। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর উম্মতের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত। তাঁদের গড় আয়ু ৬০ হতে ৭০ বছরের মধ্যে। স্বল্প সময়ে অধিক পুণ্য লাভের জন্য শবে ক্বদর আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য এক বিশেষ অফার (ঙভভবৎ) স্বরূপ। পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ক্বদরে এ মহিমান্বিত রাতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এ রাতেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়। এ রাতে আল্লাহপাক সন্ধ্যা থেকে ফজর পর্যন্ত পৃথিবীর আকাশে আগমন করেন এবং মানুষের প্রার্থনা কবুল করেন। জিব্রাইল (আ.) সহ অগণিত ফেরেশতা পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং মুমিন মুসলমান নর-নারীর জন্য শান্তি কামনা করেন।
আল্লাহপাকের খাস রহমত নিয়ে শবে ক্বদর ফি বছর একবার আবির্ভাব হয়। জীবনে অন্তত একবার এর সদ্ব্যবহার করতে পারলে আমরা বহু পুণ্য লাভের আশা করতে পারি। তাই শবে ক্বদর অনুসন্ধান করে ইবাদত করা প্রয়োজন। বর্তমানে পবিত্র রমজান মাস চলছে। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে পবিত্র শবে ক্বদরে ইবাদত করার তাওফিক দান করুন।
রমজান মাসে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়। তাই এ মাসে বেশি বেশি কোরআন চর্চা করা প্রয়োজন। মসজিদে খতমে তারাবি পড়া হয়। বহু মসজিদে প্রথম রমজান হতে ২৭ রমজানের তারাবির সালাতে ৩০ পারা কোরআন খতম করা হয়। আমাদের সমাজে ইহাই প্রচলিত। ২৭ দিনে ৩০ পারা কোরআন পড়তে প্রথম দিকের তারাবির সালাতে সময় লাগে বেশি। ২৭ রমজানে তারাবির সালাতে কোরআন খতম করে শবে ক্বদর গণ্যে বিশেষ দোয়া করা হয়। কিন্তু ২৭ রমজানের রাতে শবে ক্বদর নাও হতে পারে। ২৯ রমজানেও একটি বিজোড় রাত রয়েছে। শবে ক্বদর ফি বছর একই বিজোড় রাতে নাও থাকতে পারে। ভিন্ন বছর ভিন্ন বিজোড় রাতে হতে পারে। কেবল ২৭ রমজানের রাত ‘লাইলাতুল ক্বদর’ অনুসন্ধান ও ঘটা করে পালন করলে হবে না। এতে আমাদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা জন্ম নিতে পারে। তাই ২৯ রমজান রাতে খতমে তারাবি সমাপ্ত করা প্রয়োজন। তাতে সবকটি বিজোড় রাত তথা শবে ক্বদরে খতমে তারাবি পড়ার সুযোগ থাকবে। প্রতিদিনের নামাজে ব্যয়িত সময়ের সমতা আসবে। ২৭ রমজান শবে ক্বদর এ বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। সর্বোপরি রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলি তথা সমস্ত মাহে রমজানে শবে ক্বদর অনুসন্ধান ও ইবাদত আরাধনার মাধ্যমে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক।