শ্রদ্ধাঞ্জলি
কিশোর কবি সুকান্ত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ মে ২০২৩, ১২:২৫:৩৫ অপরাহ্ন
দুলাল শর্মা চৌধুরী:
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। তিনি তাঁর সীমিত জীবনকালে যা সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন, তা সত্যিই অনবদ্য। তিনি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদ আগ্রাসন বিরুদ্ধে সেই সময় কলম ধরেছিলেন। তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম আজও বাঙালি পাঠকদের সমানভাবে মন কাড়ে।
সুকান্ত জন্মেছিলেন ১৫ আগস্ট ১৯২৬ সালে। কোলকাতার কালীঘাট ৪৩নং মহিম হালদার স্ট্রিটে তাঁর মামার বাড়িতে। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার উনশিয়া গ্রামে। সুকান্ত ছয় ভাই বোনদের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়।
মাত্র একুশ বছর বয়সেই ১৩ মে ১৯৪৭ সালে যক্ষ্মারোগে কোলকাতার ১১৯ নম্বর লাউউড স্ট্রিটের অন্তর্গত ‘রেড এড কিউর হোমে’ মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি এই অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন এক অসাধারণ রতœভান্ডার, যার মধ্যে আমরা পাই দেশপ্রেম, সমাজের সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখ-দুর্দশার চিত্র ও প্রতিবাদী চেতনা।
সুকান্ত যখন জন্মেছিলেন, তখন তিনি দেখেছিলেন দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত সমস্ত ভারতবর্ষ। একদিকে ক্ষুধা, মন্বত্বর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গোটা বিশ্ব তখন বিপর্যস্ত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীময় জ্বলছিল তখন এক অশান্তির আগুন। পরাধীন ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছিল সে দাবানল। যুদ্ধ, দুর্ভক্ষ বিধ্বস্ত এ পৃথিবী তথা ভারতবর্ষের রূপ, ক্ষত, বিক্ষত করেছে সুকান্তের দরদী কবি হৃদয়। তাই তো ব্যথিত চিত্তে তিনি বলেছেন, ‘অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি- জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি’।
সুকান্ত জন্ম থেকেই জ্বলেছেন, বলা যায় জীবনভর জ্বলেছেন। আর এ জ্বালা থেকেই তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। তাঁর বুকের ভিতরে লুকায়িত বেদনা প্রতিবাদীর হাতিয়ার হয়ে রূপ নিয়েছে কবিতায়। যে শিশুটি সবেমাত্র জন্মগ্রহণ করেছে পৃথিবীতে তার মধ্যেও তিনি লক্ষ্য করেছেন প্রতিবাদী চেতনা। তিনি লিখেছেন, ‘যে শিশু ভূমিষ্ট হল আজ রাতে তার মুখে খবর পেলুম- সে পেয়েছে এক ছাড়পত্র এক- নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার- জন্মসূত্রে সুতীব্র চিৎকারে’। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। (ছাড়পত্র)
সুকান্ত দুঃখী-দরিদ্র সাধারণ মানুষকে নিয়ে লিখেছেন অধিকাংশ কবিতা। বাংলা সাহিত্য গণমুখী কবিতা রচনায় সুকান্তের দান অবিস্মরণীয়। সুকান্তের গণমুখী কবিতার প্রতিবাদী চেতনার মধ্যে দেশপ্রেম লুকায়িত রয়েছে। মূলত তার দেশপ্রেম ও গণমুখীতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুকান্তের গণমুখী কবিতা সামন্তবাদকে তীব্রভাবে আঘাত করেছে এবং তাদের ভিতকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। যখন অনেক কবি প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন, চাঁদকে তুলনা করেছেন প্রেয়সীর মুখের সাথে, তখন একমাত্র সুকান্তই বাস্তবজীবনের মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। (হে মহাজীবন)
সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন তার মামাতো বোন রাণীদি। সেই সময়ের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনিন্দ্র লাল বসুর ‘সুকান্ত’ গল্পটি পড়ে তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন সুকান্ত। তার প্রিয় রাণীদির জন্যই তিনি সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর রাণীদি তাঁর কোনো সাহিত্যকর্ম দেখে যেতে পারেননি, এর প্রধান কারণ তিনি খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। তারপর দিদির মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই তাঁর মাও মারা যান। এই শোকের মুহূর্তেই তিনি রচনা করেন অনেক কবিতা। নিঃসঙ্গতার সময় কবিতা লেখাই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী।
সুকান্তের বাল্য শিক্ষা শুরু হয় কোলকাতার বিদ্যামন্দির স্কুল থেকে। এখানেই তার প্রথম লেখা ছোট গল্প প্রকাশিত হয় স্কুলেরই নিজস্ব পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’। সেই স্কুলে তিনি বেশ কিছু বছর পড়াশোনা করেন এবং তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে। এরপর ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত তিনি সেই পরীক্ষায় ফেল করেন।
১৯৪৫ সালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। সেই বছরই ‘আকাল’ একটি সংকলন গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেন। এবং সেখানেই তিনি শোষিত মানুষের কর্ম-জীবন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম, সমাজের দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণমুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার সেই সব কবিতা সংকলন মানুষকে ভীষণভাবে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায় রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য।
১৯৪১ সালে সুকান্ত কোলকাতা রেডিও আয়োজিত ‘গল্প দাদুর’ আসর নামক এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। সেখানে তিনি প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তখন সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে কবি গুরুকে শ্রদ্ধা জানান।
সুকান্ত শুধু একজন কবিই ছিলেন না। তিনি একাধারে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যেমন কাজ করেছেন তেমনি আবার কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি ‘রাখাল ছেলে’ নামক একটি গীতি নাট্য রচনা করেছিলেন। যেটা পরে, ‘হরতাল’ নামক বইতেও সংকলিত হয়েছিল।
তার সমস্ত রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- ছাড়পত্র (১৯৪৭), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকেই ‘সুকান্ত সমগ্র’ রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়।
বাংলা সাহিত্য জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের অকাল মৃত্যুতে বাঙালি জাতি হারালো এক বিপ্লবী, দেশপ্রেমী এক গণমানুষের কবি প্রতিভাকে।
তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাঁকে বিন¤্র শ্রদ্ধা।