সব গাছ পরিবেশ বাঁচায় না
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০২৩, ২:০০:২৬ অপরাহ্ন

আফতাব চৌধুরী
অ্যান্টার্কটিকার জনমানবহীন মহাদেশ ছাড়া পৃথিবীতে যে ক’টি মহাদেশ আছে, প্রায় সবগুলো স্পর্শ করার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রায় ১৫টি দেশে কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করার সুযোগও আমি পেয়েছি। এ সুযোগ অনেকেরই হয়, তবে আমার ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। নানা প্রয়োজনে বহু লোকজন নানা দেশে যান। তারা সাধারণত বড় বড় শহরে বেশি সময় কাটান, সভা-সমিতি করেন। বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিষয়ক নানা সেমিনার, সিম্পোসিয়াম, সম্মেলনে যারা যান, তারা বড়ো শহরে বিলাসবহুল হোটেলে অনুষ্ঠান করে, বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে চলে আসেন। আমি বিভিন্ন কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। বড় বড় শহর ছাড়াও যেসব দেশে গিয়েছি, সেগুলোর শহরের মতো গ্রামাঞ্চলও দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।
ব্রিটেনসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের বনজঙ্গল, আমেরিকা, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের অনেক গভীরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আফ্রিকার কিছু অংশ দেখেছি। আমার সাধ্যমতো নানা জায়গায় গিয়েছি। সুতরাং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অন্যদের কাছে যা শুনেছি তার ভিত্তিতে কিছু অভিমত ব্যক্ত করছি।
প্রাকৃতিক পরিবেশের কথাই বলতে যাচ্ছি। অনেক বক্তৃতা শুনি, পোস্টার দেখি যাতে লেখা থাকে-‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। শুনতে ভালোই লাগে। যে কোনো গাছ লাগালেই পরিবেশ বাঁচে না। আমাদের বলতে হবে, দেশী গাছ লাগান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঁচান। প্রাকৃতিক পরিবেশ বলতে গেলে অপ্রাকৃতিক পরিবেশের কথা এসে যায়। পার্থক্য আমাদের অত্যন্ত গভীরভাবে বুঝতে হবে। যেকোনো গাছ লাগালে যদি প্রাকৃতিক পরিবেশ বেঁচে যেত তা হলে কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা নয়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবেশ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। কোনো একটি স্থানের বায়ু, পানি, তাপ, মাটির ধরণ ও গুণাগুণের ভিত্তিতে সে স্থানে উদ্ভিদ জন্মে। এটি নিয়ম এবং এ নিয়ম প্রাকৃতিক। একইভাবে উদ্ভিদের ধরণের ওপর ভিত্তি করে সেখানে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। আলো, বায়ু, আবহাওয়া, পানি ও মাটির সমন্বয়ে সে স্থানে অজৈব পরিবেশ গড়ে ওঠে। আবার তার ওপর নির্ভর করে যে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবির্ভাব হয় তাকে বলা হয় জৈব পরিবেশ। অজৈব ও জৈব পরিবেশ মুক্তভাবে সে স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলে। পরিবেশ বিদ্যায় পরিবেশগত পরামর্শ বলে একটি কথা আছে। সংক্ষেপে বলা যায়, উদ্ভিদহীন একটি স্থানে যখন কোনো উদ্ভিদ জন্মায়, তখন পরিবেশে পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ ওই গাছের কারণে পরিবেশ ভিন্ন রূপ নিয়েছে, যেখানে আগের গাছ টিকতে পারে না এবং ভিন্ন এক গাছ জন্মায়। একই ভাবে ভিন্ন এক প্রাণীর উদ্ভব হয়। এ ধরণের পরিবর্তন কয়েকবার ঘটার পর শেষ পর্যায়ে যে উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখা যায় তাকে বলা হয় ‘ক্লাইমেটিক ক্লাইমেক্স’ বা চূড়ান্ত পর্যায়। অজৈব পরিবেশগত কোনো বিপর্যয় দেখা না দিলে একটি স্থানের জৈব পরিবেশ সঠিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে সে স্থানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। কৃত্রিম উপায়ে অজৈব পরিবেশগত কোনো বিপর্যয় দেখা না দিলে একটি স্থানের জৈব পরিবেশ সঠিকভাবে পরিবর্তন না ঘটিয়ে সেখানে কৃত্রিমভাবে যদি অজৈব পরিবেশের পরিবর্তন করে ফেলা হয়, তবে সব ওলটপালট এবং বিলীন হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি না হতো তবে তৃতীয় বিশ্বের তথা আফ্রো-এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার কোটি কোটি মানুষকে আজো হয়তো পরাধীনতার শৃঙ্খলে জীবন কাটাতে হতো। যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিছুটা হলে স্বচক্ষে দেখেছেন, তারা স্বীকার করবেন পরাধীন দেশগুলোর স্বাধীনতা এসেছে ঐ দু’টি কারণের সফল সমন্বয় হিসেবে। এ মহাযুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্বের পানিতে-স্থলে যে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নেমে এসেছিল তার ফলে এসব দেশকে শাসন করার ক্ষমতা ঔপনিবেশিক দেশগুলো হারিয়ে ফেলেছিলো। জাপানের বাইরে এ যুদ্ধ আরো কয়েক বছর চলেছিল, কিন্তু জার্মানিতে অ্যাটম বোমা ফেলার সাহস মিত্রশক্তির হল না কেন? জার্মানিতে বোমাটি ফাটলে যুদ্ধ দুই বছর আগে থেমে যেত।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আমাদের উপমহাদেশের মানুষকে কিছুটা ভিন্ন চোখে দেখত। আমাদের প্রাণী জগৎ ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্রিটেন কিভাবে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তা নিয়ে কাউকে কথা বলতে শুনি না। আসলে ব্যাপারটি কী? উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের অনেকে বোধ করি এ নিয়ে মাথা ঘামান না। অনেক উদ্ভিদবিজ্ঞানী অর্থকরী যেকোন গাছ হলে তাকে মেনে নিতে পারেন। কিন্তু আমরা তা পারি না। সবাই জানি, এক স্থানের প্রাণী স্থানীয় উদ্ভিদের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু স্থানীয় প্রাণী স্থানীয় উদ্ভিদের সাথে হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তনের ফলে উদ্ভিদের ওপর একান্ত নির্ভরশীল। তাই যে উদ্ভিদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেসব প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে, সে উদ্ভিদ না হলে সেসব প্রাণী টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং আম গাছটি কেটে ফেলে সেখানে বহু মূল্যবান মেহগনি গাছ লাগালে চমৎকার কাঠ হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সে আম গাছকে আশ্রয় করে যেসব কীটপতঙ্গ পাখি ও পশু বেঁচে ছিল সেগুলো ঐ অচেনা গাছ থেকে বেঁচে থাকার জন্য কোনো খাবার বা সাহায্য পাবে না। যদি বাড়িতে দু’চারটি মেহগনি ইউক্যলিপটাস ইত্যাদি বিদেশী গাছ লাগান এবং সারা দেশে যদি এসব গাছ দিয়ে চমৎকার বনাঞ্চল গড়ে তোলেন, তবে সুন্দর বাগান পাবেন। কিন্তু প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। এখন সেটি হচ্ছে। অনেক গাছ আছে, যার পরাগায়ন কীটপতঙ্গ ও পশুপাখি দিয়ে হয়; সেসব গাছ উৎপাদন করলে আপনার বাগানটি কেমন দেখাবে?
আম-জাম-কাঁঠালের মতো বহু গাছ আছে যেগুলো ফল দেয়, কাঠ ও ছায়া দেয় এবং প্রাণীজগৎকে বাঁচায়। মেহগনি লাগালে একের ভিতর এক অর্থাৎ শুধু কাঠ পাবেন আর আম-কাঁঠাল লাগালে ফল, কাঠ পাবেন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা পাবে। অর্থাৎ একের ভিতর তিন। ১৭৮১ সালের ইম্পেরিয়াল ফরেস্ট সার্ভিসের অধীনে সমগ্র উপমহাদেশের প্রাকৃতিক বন উজাড় করে সে জায়গায় মেহগনি ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাশিয়া, মিনজিটি, রেইন ট্রি ইত্যাদি কত না বিদেশী গাছ এনে কৃত্রিম বনায়ন শুরুহয়েছিল। বনায়নে কিছু দেশী গাছ ব্যবহার করা হয় যেমন শাল, গর্জন ইত্যাদি। চিন্তা করুন, একটি দেশী গাছ বড়ো গাছ হোক বা তৃণলতা হোক, তার লতাপাতা-ফুল-ফল খেয়ে কত প্রাণীর প্রজাতি বাস করে। প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি স্থানে ছোটো-বড়ো যদি ১০ প্রজাতির গাছ থাকে এবং প্রতিটি গাছকে কেন্দ্র করে যদি ১০ প্রজাতির প্রাণী বাঁচে, তাহলে সেখানে অন্তত ১০০ প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যাবে। বনে যদি দেশী গাছ থাকে তবে অন্তত ১০-১২ প্রজাতির প্রাণী পাওয়া যাবে। বিদেশী প্রজাতির গাছ হলে একটি প্রাণী দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শক্তি কোনো চিন্তা না করে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করতে শুরু করেছিল। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হল, উপনিবেশবাদীরা আমাদের মঙ্গলের জন্য বনায়ন করেনি। তাদের লক্ষ্য ছিল এদেশে গাছ লাগাবে আর সে গাছ কেটে কাঠ নিয়ে যাবে নিজেদের দেশে।
আজ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য এসব পশ্চিমা দেশের মানুষ বেশি চিৎকার করছে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু যে পর্যন্ত আমাদের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও পরিবেশ ধ্বংস করার অপরাধ স্বীকার করে তারা তৃতীয় বিশ্বের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইবে, সে পর্যন্ত তাদের গলাবাজি অন্তত আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হবে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বিষয়টি বুঝে নেয়া উচিত।
তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস এবং বন্যপ্রাণী নিধনের ৮০ শতাংশ দায় যে তাদের, তা তারা বুঝলেও প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চাইবে না। কারণ তৃতীয় বিশ্বকে তারা থোড়াই পরোয়া করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৃতীয় বিশ্বের যে ক্ষতি হয়েছে, দেরিতে হলেও জাপানের সম্রাট এবং জাপান সরকার সে জন্য বারবার ক্ষমা চেয়েছেন। যুদ্ধবাজ পশ্চিমা দেশগুলোর হাতে অসহায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বোমার আঘাতে এবং দুর্ভিক্ষের কারণে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর কাউকে সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করতে আজ পর্যন্ত শুনিনি। ক্ষমা-দুঃখ ইত্যাদি তাদের অভিধানে মনে হয় নেইই!
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।