সামান্য এক ভুলে সুমনের জীবনে অসামান্য ক্ষতি
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মে ২০২৩, ১১:০৮:২৫ অপরাহ্ন
আহমাদ সেলিম :
‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এটি একটি পুরনো শ্লোগান। এই শ্লোগানের সাথে সাধারণ, অসাধারণ-সব পেশার মানুষই পরিচিত। শ্লোগানটি প্রতিটি মানুষের জীবনে এতটাই গুরুত্ব বহন করে, যে কারণে শুধু পাঠ্যপুস্তকে নয়, চলার পথে হাটে, ঘাটে, গাড়ির পেছনে- প্রায় সময় চোখে পড়ে শ্লোগানটি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাক্যটির গুরুত্ব আমরা জানি, কিন্তু মানি না। আর না মানার কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, কেউ হারাচ্ছে হাত, আবার কেউ হারাচ্ছে পা। একজনের হাত কিংবা পা হারানোর ভেতর দিয়ে একটি পরিবার সারা জীবনের জন্য অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে। সেই শূন্যতা একজীবন কেঁদেও পূরণ হয় না। যেমনটি ঘটে গেলো সুমন নামে একজন তরুণের জীবনে। একটু অসাবধানতার কারণে দুটি পা হারিয়ে বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে চোখের পানি ফেলছেন।
টগবগে তরুণ সুমন কুমার দাশ। পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন কুলাউড়া উপজেলার জয়পাশা গ্রামে। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান সুমন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর শমসেরনগর ইউনিটের তৃতীয় শ্রেণির (টিএস) একজন বেসামরিক কর্মচারী। দুই বছর আগে তিনি বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন। পরিবারে রয়েছে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। স্ত্রী পপি, কুলাউড়ার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় পড়াশোনা করছেন সিলেটের মির্জাজাঙ্গাল জালালাবাদ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজে। গ্রামে অত্যন্ত অমায়িক হিসেবে পরিচিত সুমন চাকরির পাশাপাশি টিউশনি পেশার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন বেশ কয়েক বছর ধরে।
ঘটনার দিনও স্ত্রী অপেক্ষা করছিলেন সুমনের জন্য। কথা ছিলো সিলেট যাবেন, নিজের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠেনি। একটি দুর্ঘটনা সুমনের রোদমাখা স্বপ্নকে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। দিনটি ছিলো, শনিবার, ১৩ মে। প্রতিদিনের মতো ওইদিনও সুমন শমসেরনগর থেকে অফিস শেষ করে কুলাউড়ায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হাতে ছিলো সেই টিফিনবক্র। স্টেশন আসামাত্র দেখলেন, সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্রপ্রেস ট্রেন সবেমাত্র ছেড়ে প্লাটফর্ম ত্যাগ করছে। অপেক্ষা না করে সুমন দৌড়ে ট্রেনে উঠার চেষ্টা করলেন। হাতে টিফিন বহন করায় মুঠোতে ঘাম জমেছিলো। এ অবস্থায় উঠার সময় পিচ্ছিল হাত ফসকে গিয়ে অসাবধানবশত তিনি ট্রেনের নিচে পড়ে যান। সাথে সাথে বাম পা দ্বিখ-িত হয়ে যায়। মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয় অন্য পা-টিও।
খবর পেয়ে বিমান বাহিনী শমশেরনগর ইউনিটের লোকজন হাজির হন স্টেশনে। পরে তাকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নেয়ার পর আঘাতপ্রাপ্ত অন্য পাটিও কেটে ফেলতে হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও সুমন চিকিৎসাধীন রয়েছেন সিএমএইচ হাসপাতালে। যে পা হারিয়ে গেছে সেই পা আর কোনোদিন ফিরে পাবেন না সুমন। কিন্তু যে ভুল সুমন করেছেন সেই ভুল যেন আর কোনো যাত্রী না করে সেটিই বলেছেন শমশেরনগর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার জামাল হোসেন।
ঘটনার পর থেকে সুমনের পরিবারে কান্না থামছে না। মা কাঁদছেন, স্ত্রী’র মতো ভাই-বোনেরও অশ্রুপাত হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর পুরো পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। নিমেষেই যেন সব সুখ হারিয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে সবকিছু। অথচ একদিন আগেও এমনটি ছিলো না।
আট বছর ধরে যে পরিবারে শিক্ষকতা করছেন সুমন, জয়পাশার সেই পরিবারের একজন অভিভাবক জাকির হোসেন মুহিত। কথা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। এমন ঘটনা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। শুধু সুমনের পরিবার নয়, ঘটনার পর গ্রামের অনেক পরিবার তার জন্য কাঁদছে।
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মানুষকে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে। কুলাউড়া সরকারি কলেজের লেকচারার, লেখক সিপার আহমেদ জানান, ‘আমরা ভুলে যাই-সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। অনেক সময় আমরা সময়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে জীবনকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেই। এটি ঠিক নয়। সামান্য একটি ভুলের জন্য সারাটা জীবন মাশুল দিতে হয়। একজন সুমনের কাছ থেকে আমাদেরকে সেই শিক্ষা নিতে হবে।’
মো. নুরুল ইসলাম, সিলেট স্টেশন ম্যানেজার। বিষয়টি নিয়ে কথা হলে তিনিও সমবেদনা প্রকাশ করেন। বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ে প্রায় সময় মানুষ মারা যাচ্ছে। কেউ মোবাইলে কথা বলতে বলতে দুর্ঘটনায় কবলিত হচ্ছে, আবার তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কারো জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। নিয়ম হলো সময়ের আধঘণ্টা আগে যাত্রীরা স্টেশনে এসে অপেক্ষা করবে। সেই নিয়ম অনেক যাত্রী মানতে নারাজ। তিনি বলেন, প্রায় সময় দেখা যায় মানুষ ট্রেন ছাড়ার সময় স্টেশনে এসে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এটা ঠিক না। আমাদের ট্রেন প্রতিটি স্টেশনে এসে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট অপেক্ষা করে। এর মধ্যেও মানুষ ট্রেনে ওঠে না। ট্রেন ছেড়ে দিলে বিকল্প অনেক গাড়ি স্টেশনে অপেক্ষমাণ থাকে। কিন্তু অপেক্ষা করতে চায় না মানুষ। এমন অবস্থা তৈরি হয়, যেন ট্রেনে দৌড়ে না উঠলে জীবনের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
এ প্রসঙ্গে কথা হলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. জায়েদা শারমিন সাথী এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘অধিকাংশ সময়ে এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষ সচেতন থাকে না এবং তাড়াহুড়ো করে বা একটু সময় বাঁচানোর জন্য নানা ধরনের রিস্ক নেয় এবং বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। আমার মনে হয় যেকোন ধরনের নিয়ম মেনে চলার শিক্ষা ছোটবেলা হতেই বেশি করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে-সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি।’