হাজারো ভক্তের উপস্থিতিতে লাকড়ি তোড়া উৎসব পালিত
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মে ২০২৩, ৫:০৯:০৩ অপরাহ্ন

স্টাফ রিপোর্টার : চিরাচরিত নিয়মানুসারে হযরত শাহজালাল (রহ.) ওরসকে সামনে রেখে সিলেটে লাকড়ি তোড়া উৎসব সম্পন্ন হয়েছে।
আগামী ৮ ও ৯ জুন হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে উরস। উরস সামনে রেখে গতকাল বুধবার লাকড়ি তোড়া উৎসব পালিত হয় ।
প্রতি বছর হযরত শাহজালাল (রহ.) এর দরগাহ প্রাঙ্গণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজারো ভক্ত-আশেকান জড়ো হন এই লাকড়ি তোড়া উৎসবে অংশ নিতে।
গতকাল বুধবার জোহরের নামাজের পর এ উৎসব উপলক্ষে দরগা-ই-হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার প্রাঙ্গণ থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার হাজার শাহজালাল ভক্ত ‘লালে লাল-শাহজালাল’ ‘শাহজালাল বাবা কি জয়’, ‘৩৬০ আউলিয়া কি জয়’ এবং ওলি আউলিয়া কি-জয়’-এ রকম নানা শ্লোগান দিয়ে লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বর্ণাঢ্য মিছিল নিয়ে শহরতলির লাক্কাতুড়া ও মালনিছড়া চা বাগানের মাঝামাঝি নির্ধারিত টিলার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে গিয়ে দরগাহে হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারের মোতাওয়াল্লী সরেকওম ফতেহ উল্লাহ আল আমান এর উপস্থিতিতে টিলার উপরে মিলাদ পড়া হয়, পরে মোনাজাতের মাধ্যমে লাকড়ি তোলা কার্যক্রম শুরু হয়। শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংসের শিক্ষা নিয়ে প্রায় ৭০৪ বছর ধরে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে। পরে মোতাওয়াল্লী সরেকওম ফতেহ উল্লাহ আল আমান এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় সম্মানিত অতিথি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর ড. রাগীব আলী উপস্থিত হলে দরগাহ হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারের মোতাওয়াল্লী সরেকওম ফতেহ উল্লাহ আল আমান তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। পরে বাংলাদেশ হযরত শাহজালাল (রঃ) ৩৬০ আউলিয়া ভক্তবৃন্দ পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। সম্মানিত অতিথি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর ড. রাগীব আলী বলেন, হযরত শাহজালাল (রঃ) যে উদ্দেশ্যে সিলেট আগমন করেছিলেন সেই আদর্শ হৃদয়ে ধারন করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও আভিজাত্যের গৌরব ধ্বংসের শিক্ষা নিয়ে আজকের এই লাকড়ি তোড়া উৎসবের সফলতা কামনা করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন মালনীছড়া চা বাগানের ম্যানেজার আজম খান, বাংলাদেশ হযরত শাহজালাল (রঃ) ৩৬০ আউলিয়া ভক্তবৃন্দ পরিষদ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি শেখ জালাল ফরিদ উদ্দিন, সহ সাধারণ সম্পাদক এম এ খালিক, হাজি নূরুল আলম, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ ও শাকিল উদ্দিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আলমগীর কবির, সিলেট জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ আক্তার মিয়া প্রমুখ।
সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহ.) এর স্মৃতি বিজড়িত এ উৎসব হিজরি বর্ষের ২৬ শে শাওয়াল পালন করা হয়। চা বাগানের নির্দিষ্ট পাহাড় থেকে ভক্তরা লাকড়ি সংগ্রহ করে। সেই লাকড়ি কাঁধে নিয়ে পুনরায় মিছিল নিয়ে মাজারে ফেরেন ভক্তরা। মাজারের পুকুরে লাকড়ি ধুয়ে নির্ধারিত স্থানে রেখে দেন তারা। এসব লাকড়ি বা কাঠ ২১ দিন পর অনুষ্ঠিতব্য হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর বার্ষিক উরশ শরীফের শিরণি রান্নায় ব্যবহার করা হবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৭০০ বছর আগে সিলেট বিজয় দিবসের কয়েক দিন আগে ২৬ শাওয়ালের এই দিনে এক কাঠুরে আসেন হযরত শাহজালালের (রহ.) কাছে। কাঠুরে জানান, ঘরে তার বিবাহযোগ্য ৫ মেয়ে রয়েছে। সে কাঠুরে নিচু জাতের হওয়ায় কেউই তার মেয়েদের বিয়ে করতে চাইছে না। এ কথা শুনে শাহজালাল (রহ.) কাঠুরেকে সিলেট বিজয় দিবসে দরগায় আসার কথা বলেন।
পরবর্তী সিলেট বিজয় দিবসে সঙ্গী আউলিয়া, ভক্ত ও আশেকানরা এলে শাহজালাল (রহ.) সবাইকে নিয়ে লাক্কাতোড়া বাগানে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করেন। ফিরে এসে তিনি উপস্থিত ভক্তদের কাছে জানতে চান তারা আজ কী কাজ করেছে। উত্তরে সবাই বলেন, তারা আজ কাঠুরিয়ার কাজ করেছে। এরপর শাহজালাল(রঃ) সবাইকে কাঠুরের দুঃখের কথা বললে উপস্থিত অনেক ভক্ত কাঠুরের মেয়েদের বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেখান থেকে কাঠুরে তার মেয়েদের জন্য বর পছন্দ করেন। এ ঘটনার পর থেকে সাম্য ও শ্রেণি বৈষম্যবিরোধী দিবস হিসেবেও দিনটি পালন করেন ভক্তরা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহজালাল (রহ.)’র জীবদ্দশা থেকে এভাবে লাকড়ি সংগ্রহ করা হতো।
হযরত শাহজালাল (রহ.) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে ৩৬০ সফরসঙ্গী নিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য সিলেট আসেন। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১৯ জিলকদ তাঁর ইন্তেকাল হয়। সিলেটে তিনি যে টিলায় বসবাস করতেন সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। এই মাজার সারা বছরই ভক্ত আশেকান ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে।