বন্যা ভীতি প্রসঙ্গ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মে ২০২৩, ৪:১২:৪৬ অপরাহ্ন
বেলাল আহমদ চৌধুরী
জীবনান্দ দাশ বাংলাদেশকে বলেছেন, রূপসী বাংলা’। প্রতিটি ঋতু এখানে প্রকৃতিকে সাজায় তাঁর অনুপম রূপ সজ্জায়। এক ঋতু যায়, আসে অন্য ঋতু। বাংলাদেশের উপর দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিবাহিত হওয়ায় এদেশ ক্রান্তীয় জলবায়ুর অন্তর্গত। তবে অবস্থানগত কারণে এদেশের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব প্রকটভাবে বিদ্যমান। মৌসুমি বায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বছরে বিভিন্ন ঋতুর আবির্ভাব।
ঋতু পরিক্রমার ঊষালগ্নে গ্রীষ্মের আগমনে মেঘের গুরুগর্জনের মধ্য দিয়ে মেঘ বৃষ্টির লুকোচুরি শুরু হয়েছে। বৈশ্বিক বায়ুপ্রবাহে জেটস্ট্রিমের গতিপথে নানা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই মৌসুমে জেট সিস্টেম এবং মৌসুমি বায়ু প্রবাহের মধ্যে সম্মিলন ঘটে ফলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণ হয়ে থাকে। বৈশ্বিক জলবায়ু মডিউলগুলোর নানা বিশ্লেষণে জানা যাচ্ছে যে, ভারী বৃষ্টিপাত চলতি মাসে হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের দেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘবা অববাহিকার একটা অভিন্ন নদী ব্যবস্থার অংশ। একটা অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশের সমষ্টি। যার পর আসাম, মেঘালয়ে বন্যা থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আসাম-মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের পানি সিলেট ও সুনামগঞ্জে দ্রুত নেমে আসে এবং সেই সাথে মেঘালয় ও আসামের পানি বাধাহীনভাবে বাংলাদেশে আসে কারণ হলো সেখানকার নদ-নদীতে একের পর এক বাঁধ ড্যাম নির্মাণ করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। ফলস্বরূপ পাহাড়ি ঢলের সাথে বিপুল পরিমাণ পলি মেঘনা অববাহিকার নদ-নদী দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসে। মাত্রাতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পড়ায় নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে আমাদের দেশেও শহরতলী অঞ্চলে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও আসান নির্মাণসহ টিলা কাটা, নদী, খাল-জলাশয় ভরাটের মচ্ছব। যে কারণে বন্যার পানি ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমার কারণে প্রাকৃতিক প্রবাহগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদী ব্যবস্থা সক্রিয় হচ্ছে না। নদী আর জলাভূমির মধ্যে আগে যে পার্থক্য ছিল সেটা আর থামছে না। যারপর পুরো এলাকাটাই প্লাবন ভূমিতে পরিণত হয়ে পড়ছে অধি কিন্তু মেঘনা অববাহিকায় নদী ব্যবস্থা দিয়ে উজানের পানি হাওর বাওড় দিয়ে মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে যেত সেটা আর সহজে হচ্ছে না। কারণ হলো ভৈরবে পুরাতন রেল সেতুসহ তিনটি সেতু। বর্ষার মৌসুমে উজানের পানি হাওর বাওড় হয়ে এই রুট দিয়েই মেঘনা প্রবাহে যুক্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে এই সব এলাকায় এখন বোটলনেক প্রবলেম তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ নদীর মুখ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নদী কেবলই মূল ¯্রােতধারই নয়। নদীর দুই পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে যে প্লাবন ভূমি সেটাও নদীর অংশ অনুরূপভাবে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দিয়ে রাস্তা বিনির্মাণের ফলে পানি সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় রকমের বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মোকাবেলা, ভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে মেঘনা অববাহিকা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা এবং গঙ্গা অববাহিকা যেহেতু একা বাংলাদেশের নয় সেহেতু ভারত ও গণচীনসহ সম্মিলিতভাবে অববাহিকার সমাধান করতে হবে।
অববাহিকা হলো একক প্রাকৃতিক ইউনিট, এটাকে রাষ্ট্রীয়সীমার মধ্যে ধরা যায় না। এটা হলো অবিচ্ছিন্নপ্রকৃতি ভারত-বাংলাদেশ নদী কমিশন আছে। অভিন্ন পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাতিসংঘের প্রটোকল রয়েছে। এখন সময় হয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনসহ এই অঞ্চলের পানি ও পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে এনে বৈশ্বিক পরিম-লের সাথে যুক্ত করতে হবে।
পরিশেষে বলব, গত বর্ষায় শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় ডুবে থাকা সিলেট ও সুনামগঞ্জের মানুষ চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যা পরিস্থিতি সামাল/মোকাবেলার ক্ষেত্রে আশা জাগানিয়া পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছে না। বৃহত্তর সিলেটকে রক্ষা করতে হলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খননের সাথে নগরবাসীর জলাবদ্ধতা ভীতি দূর করতে হলে দ্রুত নদী তীরবর্তী বাঁধ নির্মাণ করে জনদুর্ভোগ নিরশন করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট।