পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মে ২০২৩, ২:২৪:০৫ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট আনসার খান
অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত পাকিস্তানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে প্রস্হান এবং পরবর্তীতে তাকে গ্রেপ্তার ও হেনস্তা করার পেছনে দেশটির সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে বলে মনে করেন অনেক পাকিস্তানী সচেতন মানুষেরা। দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের প্রকৃত শক্তি যে সেনাবাহিনীর হাতেই রয়ে গেছে সেটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে, এমনটাই কিছু বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন।
পাকিস্তানের ৭৬ বছরের রাজনীতি বিশ্লেষণে দেখা যাবে, ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের সরকারগুলো সেনাবাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আধিপত্যশীল রয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি বেসামরিক সরকারের পর্দার আড়ালে সামরিক অভিজাতরাই শাসনের কলকব্জা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বলা হয়ে থাকে, বেসামরিক সরকারের আমলেও ক্ষমতার অক্ষ সেনাপ্রধানের কার্যালয়কে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের এই হাইব্রিড প্রকৃতি বেসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে ঘন ঘন স্বার্থের সংঘাতের দিকে পরিচালিত করেছে, যার পরিণতিতে বেসামরিক প্রশাসনের পতন ঘটিয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী। যেমন, সাম্প্রতিক সময়ে ইমরান খান সরকারের পতনের বিষয়ে কথা বলেছেন পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকার চৌধুরী পারভেজ এলাহী। এলাহী কোনো রাখঢাক না করেই- ‘সরকারের পতনের জন্য প্রকাশ্যে সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেছেন।’
পাকিস্তানের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা মানে রাজনীতিতে সামরিক এলিটদের সম্পৃক্ততা নিয়মিতভাবেই বাড়ছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে সেটি প্রকাশিত হচ্ছে। পাকিস্তানের সরকারগুলোর উত্থান এবং মেয়াদপূর্তির আগেই সরকারের পতনের পেছনে সামরিক অভিজাতদের ভূমিকা সুস্পষ্ট। ইমরান খানের সাম্প্রতিক ক্ষমতাচ্যুতি পাকিস্তানে হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার সর্বশেষ প্রকাশ এবং এখনও পাকিস্তানে যা ঘটে চলেছে তার পেছনেও সামরিক এলিটদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই এলিট-শ্রেণির নিকট সর্বাগ্রে তাদের শ্রেণিস্বার্থের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে পাকিস্তানের জনগণও ক্রমেই সামরিক বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইমরান খানের সমর্থকরা বিক্ষোভের সময় সামরিক বাহিনী বিরোধী শ্লোগান দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করেছে, যা এর আগে ঘটতে দেখা যায়নি।
বেসামরিক রাজনৈতিক বিষয়ে সেনাবাহিনীর ক্রমাগত হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা-উত্তর সময়কাল থেকে। বলা যায় পাকিস্তানের ভাগ্য তার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত স্বাধীনতার সময় থেকে। স্বাধীনতা-উত্তর এই দীর্ঘ ৭৬ বছর সময়কালে দেশটির নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রী-ই তার পাঁচ বছরের মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারেননি, হয় তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে, অথবা সামরিক অভুত্থানে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেশটির ৩ জন প্রধানমন্ত্রী চার বছর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ৪ জন ৩ থেকে ৪ বছর, ২ থেকে ৩ জন ৩ বছর, ৫ জন ১ থেকে ২ বছর, ৩ জন ছয় মাস থেকে একবছর এবং ৪ জন ছয় মাসের কম সময় করে প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন।
তথা-পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ৬ জন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন, ৪ জনকে সামরিক অভ্যুত্থানে পদচ্যুত করা হয়, ৩ জন খন্ডকালীন নিয়োগ পেয়েছিলেন, সুপ্রীম কোর্ট দ্বারা ২ জন অযোগ্য ঘোষিত হয়েছিলেন, একজন আততায়ী কর্তৃক নিহত হন এবং একজন আস্হাভোটে হেরে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ এই ৭৬ বছরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে অস্ত্রের মুখে অপসারণ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে অবৈধভাবে ৩৪ বছর-ই প্রত্যক্ষভাবে দেশটি শাসন করেছিলো সেনাবাহিনী সামরিক শাসন জারী করে। ১৯৪৭ থেকে তিনটি সামরিক ক্যু, এর অধীনে ৪ জন ভিন্ন সামরিক শাসক দ্বারা পাকিস্তান শাসিত হয়েছে ১৯৫৮-৭১ পর্যন্ত, ১৯৭৭-৮৮, এবং ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
অন্যদিকে এটিও সত্য যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারই তার পূর্ণমেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি শাসনে সেনাবাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে। তাছাড়া গণতান্ত্রিক শাসন চলাকালেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষকরে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সহ সমগ্র গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব শক্তির সাথে দেশটির সম্পর্কের বিষয়টি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হয়ে থাকতো। রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ দিতে অভ্যস্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কখনো বেসামরিক রাজনৈতিক শাসনের অধীনে পরিচালিত হয়নি, ক্ষেত্রবিশেষে গণতান্ত্রিক শাসনের সময়েও সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করেছে, সেনাবাহিনীর মন:পুত না হলে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে ছোড়ে ফেলে দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে একই ক্ষমতা প্রয়োগ করে মেয়াদপূর্তির আগেই পদচ্যুত করা হয়েছে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে। সুপরিচিত পাকিস্তানী সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাজাম শেঠি প্রকাশ করেছেন যে সামরিক হাইকমান্ড ইমরান খানকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন এবং খান সেনাবাহিনীর স্বার্থ সুরক্ষার জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় খানের ওপর থেকে হাইকমান্ড সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইমরান খানকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। নাজাম শেঠির মতে, সাম্প্রতিক একটি বৈঠকে জুনিয়র অফিসারদের ব্রিফিং করার সময় একজন সিনিয়র সামরিক অফিসার বলেছিলেন- ‘আপনি জানেন, তিনি দুই বছরধরে আমাদের কথা শুনছেন না এবং দেখুন তিনি ক্ষমতায় (খান) গিয়ে কী করেছেন? আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে এবং সে এভাবে চলতে থাকলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
ইমরান খানের নানাবিধ কর্মকা- সেনাবাহিনীর মনঃপুত হয়নি এবং খান হাইকমান্ডের কথা না শোনার কারণে-ই পদচ্যুত হয়েছেন, এটাই সত্য বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ইমরান খানও তাই স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন ‘পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাপ্রধান-ই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সবাই সেনাপ্রধানের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে প্রায় বাধ্য।’ খানের বক্তব্য স্পষ্ট করে যে, হাইকমান্ডকে সন্তুষ্ট করে, হাইকমান্ডের সাথে সমন্বয় ও সমঝোতা করেই রাজনৈতিক সরকারকে কাজ করতে হয়।
পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীকে এস্টাবলিশমেন্টের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারা পেছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে এবং এজন্য পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নষ্ট করার জন্য সশস্ত্রবাহিনীকে দায়ী করে তাদের সমালোচনা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছে দেশটির রাজপথে।
পাকিস্তানের এই দীর্ঘ সময়কালে না সামরিক, না বেসামরিক,- কোনো শাসকই চার-সি এর অভিযোগ বা অভিশাপ থেকে রেহাই পায়নি। এই চার-সি হলো, ক্যু (অভ্যুত্থান), করাপশন (দূর্নীতি), ক্রাইম (অপরাধ) এবং কান্ট্রি হাপিং। অর্থাৎ সরকার উৎখাত ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লোকজনকে হেনস্তা এবং অপদস্ত করে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বকে জায়েজ করার জন্যই এসব অভিশাপে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
সেনাবাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপ, সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ, নিজেদের পছন্দসই সরকার ও সামরিক বাহিনীর স্বার্থে রাষ্ট্র ও সরকারকে পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনী গত ৭৬ বছরধরেই আড়ালে থেকে ক্ষমতার কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এবং তাদের স্বার্থের প্রতিকূলে যায় এমন সরকারকে পদচ্যুত করেছে নানা অজুহাতে, বিশেষকরে ওই চার-সি ব্যবহার করে ও অভিযোগে। এইভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চা ও প্রয়োগ করে সেনাবাহিনী একটি শক্তিশালী বৃহৎ কাঠামো হিসেবে গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যকীয় অন্যকোনো গণতান্ত্রিক কাঠামো, সার্বভৌম ও কার্যকর আইনসভা, কার্যকর নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ইত্যাদি গড়ে ওঠতে পারেনি সেনাবাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে।
প্রকৃতপক্ষে, সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং একটা স্হায়ী বেসামরিক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠার পথে প্রধান বাধা ছিলো সেনাবাহিনী,-এমনটি মনে করেন বিশ্লেষকরা। ওই বাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তানে কোনো সরকারই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, এটি দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস বলে দেয়।
একটি জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক দলব্যবস্হা অপরিহার্য। কিন্তু সত্য হলো তেমন কিছুই গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি পাকিস্তানে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো দেশের প্রথম থেকেই দূর্বল ছিলো। যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলো, সেই দলটির দলীয় শিকড় ভিত্তি পায়নি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই দূর্বলতা সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর সাথে জোট করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা ও টিকে থাকার পথ বেছে নিয়েছিলো রাজনৈতিক দলগুলো। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খানরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।অর্থাৎ ওইসব নেতৃত্বের দূর্বলতায় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ক্রমেই শক্তি অর্জন করতে থাকে।
এই সামরিক বাহিনীতে ছিলো পাঞ্জাবি ও পাঠান জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্য এবং জনভিত্তিহীন রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলো, যা পরবর্তী বছরগুলোতে সেনাবাহিনীর আধিপত্য রাজনৈতিক ব্যবস্হায় কর্তৃত্ববাদের প্রাথমিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করেছিলো। তাই সেনাবাহিনী ও তার প্রধানের মতামত বা ইচ্ছেটাকে উপেক্ষা করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে ছিলো প্রায় অসম্ভব এবং যখনই শাসকেরা উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে, তখনই শাসনের অবসান অনিবার্য হয়ে ওঠেছিলো।
পাকিস্তানী-আমেরিকান ইতিহাসবিদ আয়েশা জালাল যুক্তি দেন যে রাষ্ট্র গঠন শুরু থেকেই যুদ্ধ-নির্মাণের ধারণা অনুসরণ করে, যা সামরিক ও প্রতিরক্ষা ব্যয়ের উপর একটি টেকসই রাজনৈতিক অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করে। রাজনৈতিক অর্থনীতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারকে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং পাকিস্তানের সীমানা ও আদর্শ রক্ষায় সামরিক বাহিনীর অব্যাহত ভূমিকার পথ প্রশস্ত করেছে এবং এখন অবধি, পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি নিরাপত্তা রাষ্ট্র হিসেবে সর্বোত্তম সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে নয়।
সেনাবাহিনীকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিলো, যেটি ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করতো, ভারত ও অন্যান্য বহিরাগত সম্পর্কে চরম সন্দেহের একটি মানসিকতা গড়ে তোলেছিলো জনমনে এবং ক্রমেই সেনাবাহিনী প্রায় চ্যালেঞ্জহীন কর্তৃত্ববাদী শক্তির অধিকারী হয়ে উঠে এবং এই বাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী সিদ্ধান্তমূলক খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় এবং গত ৭৬ বছরধরেই দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, নির্বাচিত সরকার ও অপরাপর গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে আসছে সেনাবাহিনী।
পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাস এটি বলে যে, সামরিক বাহিনীকে সংস্কার করার জন্য এবং এটিকে বেসামরিক এখতিয়ারের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হলেও সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যক্ষভাবে অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে পর্দার আড়ালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারদের অস্থিতিশীল ও দূর্বল করার চেষ্টা করা সহ সরকার উৎখাতের কাজটি করেছে সেনাবাহিনী। রাজনীতিতে সাড়ে সাত দশকের প্রকাশ্য বা গোপনীয় সামরিক সম্পৃক্ততা মূলত পাকিস্তানের সবচেয়ে গভীর মূল সমস্যাগুলোকে আরও গভীর করে তোলেছে, বলে মনে করেন রাজনীতিবিজ্ঞানী অধ্যাপক আকিল শাহ।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক কমান্ডের মধ্যে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিকভাবে রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ফলে পাকিস্তান একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি কখনো। তাই শুধু রাজনীতিই নয়, সমাজও গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এই ৭৬ বছরে। ফলে- ‘সংকট বেশ গভীরতর হচ্ছে এবং তা থেকে উত্তরণের পথ খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে’ -মন্তব্য করেছেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো মাহিদা আফজাল।
‘পাকিস্তানের সমস্ত প্রতিষ্ঠান কাদামাখা- সামরিক, আইনসভা, ও বেসামরিক সরকার, বিচার বিভাগ উভয়ই সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ভাবে মেরুকরণ করা হয়েছে, তাদের উপর জনগণের কোনো আস্থা নেই এবং তারা পাকিস্তানকে টেনে তোলতে পারছে না’ বলেন মাহিদা আফজাল।
পাকিস্তানী অধিকাংশ বেসামরিক নাগরিক মনে করেন সেনাবাহিনী কখনো দেশের সীমানার বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারেনি, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাজনীতিবিদ সহ নিরীহ সাধারণ জনগণের উপর বর্বর নির্যাতন করে শান্তিপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে বছরের পর বছরধরে এবং সেনাবাহিনী দেশটিকে একটি ভঙুর রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে গেছে, যেকোনো সময় রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ার জন্য খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে।
সূত্র : ইউনাইটেড স্টেট ইনস্টিটিউট অব পিস, আউটলুক, আটলান্টিক কাউন্সিল, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ডি ডাব্লিউ নিউজ, দ্য ডন, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞানী ড. নাদিম মালিকের নিবন্ধ।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।