বাংলাদেশে নজরুল চর্চা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মে ২০২৩, ১২:০৩:২৪ অপরাহ্ন

মোহাম্মদ আবু তাহের
কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি সবসময় অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। সাহস নিয়ে লিখেছেন। এজন্যই তিনি বিদ্রোহী কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম অসংখ্য গানের রচয়িতাও। ভারতবর্ষ যখন ইংরেজদের সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে তখন ১৯২১ সালে গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন হয়। সেই সময় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য অনেক ভারতীয়কে কারাগারে বন্দি করা হয়। তখন কাজী নজরুল ইসলামকে বন্দি করা হয়। তখন ১৯২১ সালে জেলে একটি
কবিতা লিখেন। তাই তাঁর নাম হয় বিদ্রোহী কবি। নজরুল তাঁর জীবদ্দশায় অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছেন। একসময় তিনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
দীর্ঘ সময় তিনি বাকরুদ্ধ ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, যদি আর বাঁশি না বাজে আমি কবি বলে বলছিনা আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সে অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরবে অভিমানে চিরদিনের জন্য চলে যাবো।
নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। নজরুলের আবির্ভাব ছিল আলোকবর্তিকা মতো। তিনি একটি আশাহীন, দিশাহীন জাতীর মধ্যে ফিরিয়ে এনেছিলেন আত্মবিশ্বাস, উদ্বোধন ঘটিয়ে ছিলেন আত্মশক্তির। তিনি লিখেছেন ‘বিশ্বাস আর আশা যার নাই যেওনা তার কাছে। নড়াছড়া করে তবুও সে মরা, জ্যান্ত সে মরিয়াছে। নজরুল যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সবধরনের শোষণ, নির্যাতন, সা¤্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য উচ্চারণ “মানুষদের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান” উচ্চারিত হয়েছে নজরুলের কন্ঠেই।
নজরুল পৃথিবীর একমাাত্র কবি সরাসরি আঘাত করেছেন সা¤্রদায়িকতার উপর, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র। অনন্য সাধারণ ব্যঞ্জনায় রচনা করে গেছেন নজরুল তাঁর অমর পংক্তিমালা ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান। মুসলিম তার নয়নমনি-হিন্দু তাহার প্রাণ’।
জাতীয় কবি বলে গিয়েছেন ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’। কবি ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারানোর আগপর্যন্ত তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন, এসময়ের মধ্যে তিনি শিল্প সাহিত্যকে যা দিয়েছেন তা বাংলাদেশের তথা বিশ্ব পরিমন্ডলে অমূল্য সম্পদ।
একটি কবিতা কিভাবে যুগের আকাক্সক্ষাকে আলোড়িত করতে পারে, মানুষকে আন্দোলিত করতে পারে,অন্যায়ের বিরুদ্ধে শানিত শক্তি দিতে পারে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বিদ্রোহী কবিতা এর উজ্জল দৃষ্টান্ত। নজরুল বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা চেতনা ও আনন্দ বেদনার সঙ্গী। তিনি সাম্যের কবি, মানবতার কবি, জাগরনের কবি।
তিনি বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সংস্কৃতির কর্ণধার। শোষিত বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সমাজের সব অসংগতি দূরকরার নিমিত্তে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। সমাজের শোষক ও শোষিতের পার্থক্য দূরীকরণের লক্ষ্যে লিখতে গিয়ে কারাবরণ করেছেন। তবুও তিনি আপস করেননি, থেকেছেন অবদমিত। তাঁর রচনার পরতে পরতে গণমানুষের যন্ত্রণাবোধ থেকে মুক্তির মন্ত্র দেদীপ্যমান হয়ে আছে। ব্যক্তি জীবনের ভয়াল রূপটির তাকে অনেক বড় করে তুলেছে। কবিতায় তাই তিনি বলেছেন হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান/ তুমি মোরে দায়িাছ খ্রীস্টের সম্মান। কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নয় বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসেও দুর্লভ দৃষ্টান্ত। নজরুল বলতেন কোন ধর্ম, কোনজাতি বা মানবের প্রতি বিদ্বেষ আমার ধর্মে নাই, কর্মে নাই,মর্মে নাই।
নজরুল অতি সহজভাবে বলে গেছেন “গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান”। জাতীয় কবিতামঞ্চের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘কবিতা হোক অধিকার আমাদের শ্লোগান’ এই প্রত্যয়কে সামনে রেখে ১৫ টি দেশের কবিদের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট ঢাকায় ২৫ মে ইন্টারশ্যানাল নজরুল পয়েট্্ির ফেস্টিভ্যাল এর আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ‘সেরা পুস্তক সম্মাননা ২০২৩’ প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লেখকদের সম্মাননা জানানো হয়। আমার লেখা প্রবন্ধও অন্যতম সেরা রচনা হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
সকল অরাজকতা, অশুভ শক্তির আস্ফালন বন্ধ করতে কবিতা ও সাহিত্য অনন্য ভুমিকা রাখতে পারে। সাহিত্যের শক্তি হচ্ছে মহা শক্তি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণআন্দোলনসহ ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে, লেখক, কবি ও সাহিত্যিকরা অবদান রেখেছেন। সাহিত্য চর্চা যত বাড়বে সংস্কৃতিও তত বেশি শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা, নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সরকারের পক্ষ থেকে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। জাতীয় কবিতা মঞ্চ সে কাজটি করে যাচ্ছে বলে মনে করি।
কবিতা নিজেই একটা জীবন ভাবনা, জীবন যাপনের ধরন। মহাবিশ্বের সকল বিস্ময় কবিতার মধ্যে ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ একটি ধানের শীষের উপর শিশির বিন্দুকে কবিতায় তুলে এনেছেন। চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদা কবিতাকে শান্তির ভাষা বলেছেন। কবি ও কবিতা কারও দায় মেনে চলে না। সেটিই সব চেয়ে বড় শক্তি। পৃথিবীতে অবাধ স্বাধীনতা বলে যদি কিছু থাকে তবে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে কবি ও কবিতা। কবিতা আমাদের বোধ ও ভাবনার জগৎকে বড় করে। জীবনকে বিস্তৃত করে। গভীর সত্যের প্রকাশ পাওয়া যায় কবিতার মাধ্যমে। জীবনকে বিচিত্রভাবে দেখেন কবিরা। পাবলো নেরুদা, জালাল উদ্দিন রুমি কিংবা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা বদলে দিতে পারে যে কোনো মানুষের জীবন। কবিদের কবিতা মানুষকে নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যেতে পারে। মানুষকে আশাবাদী করে তুলেন কবিগণ। কবিরা মানুষের মনের কথা বলেন। মানুষের অধিকারের কথা বলেন। পরিবেশ ও প্রকৃতির কথা বলেন।
নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। সাম্য-মৈত্রী, প্রেম ও দ্রোহের কবি। তিনি আমাদের চেতনা। এই চেতনাকে এগিয়ে নিতে হবে ব্যাপকভাবে নজরুল চর্চার মাধ্যমে। বাংলাদেশে নজরুল চর্চা আরো বিস্তৃত হোক, নজরুল চর্চার মাধ্যমে নজরুল মানস ঠিকে থাকুক আমাদের তারুণ্যে, এই প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট