শেখ হাসিনার সিলেট শুভাগমনের ৪৩ বছর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২৩, ২:০২:২১ অপরাহ্ন

মুকির হোসেন চৌধুরী
আজ ২৯ মে। জননেত্রী বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার সিলেট সফরের ৪৩ বছর পূর্ণ হলো। এ দিনটি সঙ্গত কারণেই আমার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। স্কুলে অধ্যয়ন থাকা অবস্থায় এ দিনটির সাথে নিজে জড়িত ছিলাম বলে সোনালী সেই স্মৃতি আজো ভুলতে পারিনি মুহূর্তের জন্য। শৈশবে লেখালেখির অভ্যাস থাকলেও এখন আর সেই অভ্যাস নেই। কিন্তু প্রয়োজন আইন মানেনা, প্রয়োজনের তাগিদ বোধ তীব্র হওয়ায় শেষ পর্যন্ত স্মারণীয় মুহুর্তের কিছুটা শেয়ার করতেই আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
১৯৮১ সালের ২৯ মে। জাতির জনকের কন্যা এবং বাংলাদেশের বর্তমান সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা সিলেটে আসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর প্রায় ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তান সহ স্বমীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। ফলে তারা খুনিদের হাত থেকে প্রানে বেচে যান। দেশে ফেরার মাত্র বারো দিন পর অর্থাৎ ২৯ মে ১৯৮১ সালে সকাল ১০:৪৫ মিনিটে পুন্যভূমি সিলেটের রেলষ্টেশনে অবতরন করেন। পিতা মাতা ভাই হারা এতিম শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য সর্বস্তরের লক্ষ লক্ষ মানুষে ঢল নামে সিলেট রেলষ্টেশনে। ষ্টেশন থেকে তিনি হযরত শাহজালাল (রাঃ) মাজার জিয়ারত করতে যান। এরপর বিকালে সিলেটের ঐতিহাসিক আলীয়া মাদরাসা মাঠে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন। ওই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করবো আমি। সেদিনের সেই আনন্দ উচ্ছ্বাস আমার স্মৃতিপটে সজীব আছে এবং আমৃত্যু থাকবে বলে মনে করি।
শুরুতেই যে কয়টি কথা বলতে চাই, এই শহরের একজন বাসিন্দা হিসেবে আমাদের পরিবারের মোটামুটি একটা ভালো পরিচিতি রয়েছে। আমার পিতা প্রয়াত ডাক্তার এম হোসেন চৌধুরী সিলেটের একজন স্বনামধন্য এবং খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্ত চিন্তার একজন মানুষ। সেই হিসেবে নাগরীর সর্বমহলে আমার পিতা ছিলেন সমাদৃত। সরাসরি রাজনীতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক না থাকলেও মুক্ত চিন্তার মানুষ হিসেবে সেই সময়কার সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে আমার পিতার ছিলো নিবিড় সম্পর্ক। বলা যায় সেই সম্পর্কের সুবাদে সর্বোপরি একজন বিদগ্ধ সচেতন লোক হিসেবে সিলেটের প্রগতিশীল তৎকালীন রাজনৈতিক পুরোধাবৃন্দের নিয়মিত আড্ডাস্থল ছিলো আমাদের দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলাস্থ বাড়িটি। তখন থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দেরও নিয়মিত যাতায়াত ছিলো আমাদের বাড়িটিতে। প্রতিদিন অনির্ধারিত বৈঠকের জন্য আমাদের বাড়িটি ছিলো তখন সকলের কাছে বেশ পরিচিত। এরই খেসারত হিসেবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন এদেশিয় পাকিস্তানি এজেন্টদের সহযোগীতায় আমাদের বাড়ি, আমার বাবার চেম্বার, ফার্মেসীসহ আমাদের সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই ঘটনায় আমাদের অনেক কিছু ধ্বংশ হয়ে গেলেও চেতনা থেকে সরে যায়নি আমার পরিবারের দেশপ্রেম। সেই ক্ষত বহন করে মুজিবাদর্শের রাস্তায় আমি কাটিয়ে দিয়েছি আমার জীবনের একটি সোনালী অধ্যায়। আজ সেই স্মৃতিগুলো বারবার চোখের কোণে ভেসে উঠছে। বিশেষ করে ২৯ মে শেখ হাসিনার সিলেট আগমনের ৪৩ বছর। ১৯৮১ সালের এই তারিখে স্কুল পড়ুয়া অবস্থায় সেই স্মৃতি আজো বহন করে চলেছি।
সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভা হবে। জনসভার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমি তখন সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র এবং ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ওই সভায় তখন শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে আমার লেখা মানপত্র পাঠ করার সুযোগ পেয়ে যাই। তৎকালীন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আবদুর রহিম, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সৈয়দ আবু নছর, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুর রহমান শফিক, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. দেওয়ান নূরুল হোসন চঞ্চল তখন সভামঞ্চের দায়িত্বে। সভামঞ্চে উপস্থিত সকলের মাধ্যমেই আমার লেখা মানপত্র কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সেদিনের আবহাওয়া প্রতিকূল ছিলো। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাও প্রকৃতির বৈরি পরিস্থিতিতে বক্তৃতা দান থেকে বিরত থাকেন। আর যারা বক্তব্য দিয়েছেন, প্রত্যেককেই সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে হয়েছে। প্রতিকুল পরিস্থিতির কাছে আমাকেও তাই হার মানতে হলো। অবশেষে পাঠ না করেই আমার লেখা সেই মানপত্রটি জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে দিয়েছিলাম। একটি বিশেষ আবেগ নিয়ে মানপত্রটি লিখেছিলাম। তাই আবেগতাড়িত হয়ে দুতিনদিন পর জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একখানা চিঠি লিখি। সেদিনের সেই পত্রে শ্রদ্ধেয় আপা সম্বোধন করে কি লিখেছিলাম সেটি আজ আর মনে না থাকলেও আমার চিঠির উত্তর পেয়ে যাই নেত্রীর কাছ থেকে।
তারপর থেকে মানপত্র পাঠ না করার সেই আক্ষেপ আমার মধ্যে কাজ না করলেও সেই স্মৃতি আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাননীয় নেত্রী সেই চিঠিতে আমাকে ‘¯েœহের ছোট ভাই মুকির’ বলে উল্লেখ করেন। এই চিঠিটি দীর্ঘদিন থেকেই আমার সংগ্রহে ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় আমাদের ব্যক্তিগত পাঠাগারের বইপত্র, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ এবং ওই চিঠিখানা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আজকের প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম সিলেটে অসা উপলক্ষে প্রদত্ত মানপত্র দেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণের সুখকর স্মৃতি এবং তাঁর লিখিত পত্রের প্রাপ্তির আনন্দ এবং পত্র হারানোর বেদনা আমার জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়।
সেদিনের সেই স্মৃতি এবং আমার শৈশব নিয়ে প্রকাশিত আত্মজৈবনিক বই স্মৃতি, সরণী গ্রন্থে… আওয়ামী লীগের তৎকালীন জেলা সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সৈয়দ আবু নছর লিখেন, ১৯৮১ সালে। আওয়ামী রাজনীতির তখন বিরাট ক্রান্তিকাল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সিলেট আসবেন। জনসভা হবে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে। ২৯ মে জনসভার তারিখ নির্ধারণ করা হলো। তারপর থেকে শুরু হলো জনসভা সফলের লক্ষে সকল প্রকার গণসংযোগ। অবশেষে জনসভার দিনে লোকে লোকারণ্য আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ। আমি জেলার সকল দায়িত্বশীল নেতাদের নিয়ে বক্তাদের তালিকা তৈরি করছি। হঠাৎ আওয়ামী লীগ নেতা ডা. দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল এগিয়ে এসে একটি ছোট্ট টোকেন আমার হাতে গুজে দিলেন। তাতে লেখা মানপত্র পাঠ করবে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র কিশোর বালক মুকির হোসেন চৌধুরী। আমি তখন বেশ আনন্দের সাথেই টোকেনের নামটি কর্মসূচিতে তালিকাভুক্তি করি। অবশ্য কিশোর বয়সের এই বালকটি তখন সিলেটের আওয়ামী ঘরানার সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকটই পরিচিত। অপেক্ষায় রইলাম কিশোর কণ্ঠে সেই মানপত্র পাঠ শুনবো বলে। সকাল থেকে দিনের আবহাওয়াটাও খুব ভালো ছিল না। অবশেষে ভাবনাই সত্যি হলো। সভা আদৌ করা যাবে কিনা সন্দেহ ঘনীভূত হলো। অবশেষে প্রকৃতির কাছে হার মেনে সবাইকে সংক্ষিপ্ত করেই সভা শেষ করতে হয়েছিল। আর মানপত্র পাঠক আজকের মুকির হোসেন চৌধুরীর সেই মানপত্র তার মাধ্যমেই তুলে দেওয়া হয়েছিল অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে। প্রকৃতির বৈরিতার কারণে সেদিন তার নিজ কন্ঠ থেকে মানপত্র পাঠ না শুনতে পারার আফসোস এবং তার হতাশার চাপ মিশ্রিত মুখটি আজো ভুলতে পারিনি।
লেখক : কলামিস্ট।