মাদকমুক্ত সমাজ চাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২৩, ২:১২:০২ অপরাহ্ন

মো. লোকমান হেকিম
একটি সুন্দর বাগানকে বিনষ্ট করার জন্য যেমনি একটি হুতোম পেঁচাই যথেষ্ট তেমনি যুব-তরুণ সমাজকে বিনষ্ট করার জন্য মাদকই যথেষ্ট। মাদক আগ্রাসন যুবসমাজকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে সে প্রশ্ন এখন জনমনে। মাদকদ্রব্য এক ভয়াবহ সমস্যার কারণে পরিণত হয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে আজ মাদকের ভয়াল বিস্তার। সর্বনাশা মাদকদ্রব্য আমাদের গোটা সমাজকে গ্রাস করে চলেছে। এর শিকার যুব-তরুণ সমাজ। মাদক নিয়ে অতিতে অনেক লেখালেখি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মাদক একটি সমাজিক ব্যাধি। আমাদের দেশের ছেলে বা মেয়ে মাদকাসক্ত- খবরটি শোনার পর বাবা-মা কী করেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কেউ সন্তানের নেশার খবরটি বাবা-মায়ের কানে তুললে তারা তা বিশ্বাস করতে চান না । সন্তানের প্রতি বাৎসল্য তাদেরকে এই ভয়াবহ খবরটি মানসিকভাবে অস্বীকার করতে অনুপ্রাণিত করে। আরো বেশ কিছু দিন পর যখন একাধিক সূত্র থেকে একই ধরনের খবর আসতে থাকে, তখন হয়তো তারা কিছুটা সন্দিহান হন এবং এরপর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার উদ্যোগ নেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যখন তারা নিশ্চিত হন, তত দিনে সন্তানের মাদকসক্তি প্রাথমিক পর্যায় ছাড়িয়ে গড়িয়েছে অনেক দূর। এর পর অনেকে বকাঝকা-মারধর করে, ভয় দেখিয়ে সন্তানকে মাদকের পথ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন, যা কখনো সফল হয় না।
গোপনীয়তার বাঁধটুকু ভেঙে যাওয়ার পর মাদকসেবী সন্তানের জোর বা জেদের কাছে অনেকে পরাস্ত হয়ে নেশার টাকা জোগান দিতে থাকেন। কেউ কেউ অন্য কারো কাছ থেকে শুনে বা নিজেরাই মাদকাসক্তির চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। কিন্তু মাদকাসক্তির চিকিৎসা বলতে অভিভাবকেরা কী বোঝেন, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। যেকোনো কারণেই হোক, অনেকের ধারণা, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে কিছু দিন কোনো ক্লিনিকে ভর্তি রাখলে বা ‘রিহ্যাব’ করালে সে সুপথে ফিরে আসে। সে কারণে তারা কিছু দিন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র বা ‘রিহ্যাব’ হিসেবে পরিচিত কোনো ক্লিনিকে সন্তানকে ভর্তি রাখেন। সেই ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে কিছু দিন পর যখন ব্যক্তি আবার মাদকের পথে ফিরে যায়, তখন তারা আগের ‘রিহ্যাব’ ভালো নয় ধারণা করে আবারো নতুন কোনো ‘রিহ্যাব’-এ ভর্তি করান এবং এই চক্র চলতে থাকে। কারো কারো ধারণা, মাদকাসক্তি চিকিৎসার জন্য কোথাও ভর্তি রাখার প্রয়োজন নেই, কাউন্সেলিং’য়ের মাধ্যমেই মাদকাসক্তি থেকে ব্যক্তিকে সুপথে আনা যায়। অভিভাবকেরা আশা করেন, তার সন্তানকে একজন কাউন্সিলর ‘ভালোভাবে’ কাউন্সেলিং করে দেবেন, যাতে সে আর ওপথে না যায়। কয়েক সেশনের কাউন্সেলিংয়ের পরও যখন মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদক সেবন করেই চলে, তখন কাউন্সিলর ভালো না বলে বিষোদগার করেন অভিভাবকেরা।
মাদকের ধরনভেদে সপ্তাহ থেকে মাসের ভেতর শরীর থেকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই মাদকের উপাদান বেরিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে ‘ডিটক্সিফিকেশন’ বলা হয়। কিন্তু এটিই মাদক চিকিৎসার শেষ নয়, কেবল শুরু বলতে পারেন। নিয়মিত মাদক সেবনের তীব্র প্রভাব কেটে যাওয়ার পর মূল কাউন্সেলিং ও রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম শুরু হয়। যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, শরীর থেকে মাদক বেরিয়ে গেলেও তাদের মস্তিষ্কে মাদকের ক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন হয়ে থাকে, যার কারণে তাদের আবারো মাদক নেয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ‘ডিটক্সিফিকেশন’-এর পর মাদক থেকে দূরে থাকাই ব্যক্তির জন্য প্রধান যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে তার একার প্রচেষ্টায় জয়ী হওয়ার আশঙ্কা কম। এ ব্যাপারে মানসিক রোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সোশ্যাল ওয়ার্কারসহ সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় জড়িত পেশাজীবীদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি পরিবার ও আত্মীয়স্বজনেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে শুধু মাদকের কুফল সম্পর্কে সাবধান করে দিলেই সে মাদক থেকে দূরে থাকতে পারবে না। বারবার মাদকের পথে পা বাড়ানোর পেছনের কারণটি অনুধাবণ করতে হবে। সাইকোলজিস্ট সে কারণটি বের করে আনতে পারেন এবং তা থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দিতে পারেন, কিন্তু তা কার্যকর করতে হবে পরিবারকেই। ব্যক্তির জীবনযাপনকে নিয়মতান্ত্রিক করতে হবে। ব্যক্তিকে যেমন ইতিবাচক হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তেমনি তার জন্য ইতিবাচক একটি পরিবেশেরও ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ক্লিনিক বা রিহ্যাব সেন্টারে রেখে প্রাথমিকভাবে হয়তো এই কাউন্সেলিং বা জীবনযাপন প্রণালীর ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করা যায়, কিন্তু সব কিছুর পর ব্যক্তিকে ফিরে যেতে এবং জীবন যাপন করতে হবে তার পরিবার ও সমাজেই।
সুতরাং সেই পরিবার ও সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন বা ইতিবাচক পরিবেশের প্রয়োজন। শুধু ওষুধ বা ‘বোঝানো’তেই মাদক থেকে মুক্তি মিলবে না। পরিবারের কাজ শুধু চিকিৎসার পেছনে টাকা খরচ কিংবা চিকিৎসক-সাইকোলজিস্টের কাছে আনা-নেয়ায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং মাদকাসক্ত ব্যক্তির ব্যাপারে চিকিৎসক-সাইকোলজিস্টদের সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা এবং দায়িত্ব¡ নিয়ে তাদের পরামর্শ মেনে চলা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আবার সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকাও অনস্বীকার্য নয়। চার দিকে মাদকের সহজলভ্যতা নেশাসক্তির অন্যতম কারণ। বারবার মাদকের পথে পা বাড়ানোর পেছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে, যা ব্যক্তি বা পরিবারের একার পক্ষেও হয়তো সমাধান করা সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রকে তা বুঝতে হবে এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশের এ অবক্ষয় রোধে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ।
লেখক : কলামিস্ট।