প্রাথমিকের সমস্যাবলী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২৩, ৩:২৩:২৩ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানোর পরও এর গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এ ব্যাপারে সরকারের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। নানা কারণে প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাবলী প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রাথমিক শিক্ষার মান কত নিচে অবস্থান করছে তা একজন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের পরিদর্শন পরবর্তী বক্তব্য থেকেই সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে। একটি উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর সমন্বয় সভায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তার বক্তব্যে প্রাথমিক শিক্ষার করুণ অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গেলাম। ওই বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ৮ জন, শিক্ষার্থী ১৬০ জন। পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ৩২ জন। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমার পরিদর্শনের তারিখে পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিত ২৫ জন। আমি পঞ্চম শ্রেণির উপস্থিত শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে বাংলা বইটি পড়তে বললাম। দুঃখজনক ঘটনা হলো, একজন শিক্ষার্থীও বাংলা পড়তে পারলো না। যেহেতু বাংলা বিষয়টি কেউই পাঠ করতে পারেনি সেই ক্ষোভে আমি ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে আর কোনো প্রশ্নই করলাম না। সরকার ওই বিদ্যালয়ে ৮ জন শিক্ষককে জনপ্রতি গড়ে ২৫,০০০ টাকা করে দিলে প্রতি মাসে বেতন বাবদ দিয়েছে ২ লক্ষ টাকা। এ হিসেবে বিগত ৫ বছরে দিয়েছে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। সরকার এত টাকা শিক্ষকদের বেতন বাবদ খরচ করলেও ফলাফল শূন্য। কারণ শিক্ষার্থীরা ওই বিদ্যালয়ে বিগত ৫ বছর লেখাপড়া করেও বাংলা পড়তে পারেনি। ওই করুণ পরিস্থিতির জন্য প্রথমত ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণই দায়ী। কারণ শিক্ষকগণ রীতিমত পাঠদান করেন না বলেই ৫ বছর লেখাপড়া করে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধভাবে বাংলা পড়তে পারে না। শিক্ষকদের অনিয়মের কারণে প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেক পিছিয়ে আছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে সমস্যাটি নিত্যদিনের তা হচ্ছে কক্ষ সংকট। অবকাঠামোগত সমস্যা প্রাথমিক শিক্ষাকে চরমভাবে ব্যাহত করছে। সরকার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিল্ডিং দেয়া হচ্ছে বটে; কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। কোনো বিদ্যালয়ের কক্ষ সংকট সমাধানের জন্য শিক্ষা অফিসে আবেদন গৃহীত হওয়ার পর তা বাস্তবায়ন হতে বছরের পর বছর চলে যায়। কক্ষ সমস্যার দ্রুত সমাধানের কোনো ব্যবস্থাই নেই। দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ই ৩/৪ কক্ষ বিশিষ্ট। অথচ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে ন্যূনতম ১০/১২টি কক্ষ থাকা অতি প্রয়োজন। সেখানে ৩/৪ কক্ষ দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা কিভাবে আশা করা যায়- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট তো আছেই। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বারবার শিক্ষক নিয়োগ দিলেও শিক্ষক সংকট নিরসন হচ্ছে না। স্থানীয়-জাতীয়-দৈনিক খুললেই দেখা যায়, ‘১ শিক্ষক দিয়েই চলছে এই বিদ্যালয়, ২ শিক্ষক দিয়েই চলছে সেই বিদ্যালয় অথবা শিক্ষক শূন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়- পাঠদান করছেন অভিভাবকরা’- এসব সংবাদ দেখে আমরা অবাক হই। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করে দেন কিন্ডার গার্টেনে। প্রাথমিকে ৮০% শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় মহিলা। এই মহিলারা সন্তান-লালন ও ঘর ঘুচানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ জন্য তারা বারবার নানা কারণে ছুটি নিয়ে থাকেন। ফলে শিক্ষক সংকট লেগেই থাকে। শুধু তাই নয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মহিলা শিক্ষকগণ সন্তান লালন ও ঘর ঘুচানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলেই তাঁরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েও পাঠদানে সঠিকভাবে মন দিতে পারেন না। যত দিন যাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করছে।
শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা দিতে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছেন শিক্ষাবিদেরা। এই দক্ষতা বাড়ানোর অন্যতম পথ হলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে উল্টো পথে হাঁটছে শিক্ষা প্রশাসন। শিক্ষাবিদদের পরামর্শে ও জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশের সঙ্গে মিল রেখে পিটিআইগুলোতে ১৮ মাসের কোর্স চালু করা হয়েছিল। একে সংকুচিত করে ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। এমনভাবে এই ১০ মাস নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণ হবে মাত্র ৬ মাস। শুধু তাই নয়, বিদ্যমান শিক্ষক শিক্ষা কর্মসূচিকে গুরুত্বহীন করতে চলমান ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্সের নামই পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে এই প্রশিক্ষণের নাম হবে মৌলিক প্রশিক্ষণ। সারা দেশে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এগুলোয় মোট শিক্ষক আছেন চার লাখের মতো। বর্তমানে দেশের ৬৭টি পিটিআইয়ের অধীনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এটি সব শিক্ষকদের জন্যই বাধ্যতামূলক। একসময় এই প্রশিক্ষণ কোর্সটির মেয়াদ ছিল এক বছর। তখন এর নাম ছিল ‘সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড)। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ এই কোর্সের মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে ১৮ মাস (দেড় বছর) করার কথা বলা হয়। এরপর শিক্ষানীতির সুপারিশ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ২০১২ সালে প্রথমে সাতটি বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পিটিআইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বছর মেয়াদি কোর্স চালু করা হয়। গুরুত্ব বিবেচনা করে এই কোর্সের নাম দেওয়া হয় ‘ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন’। এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সাল থেকে দেশের সবকটি পিটিআইয়ে এই কোর্স শুরু করা হয়। পিটিআইগুলোর এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটির কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করছে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। গত ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে পিটিআইয়ের মাধ্যমে চলমান শিক্ষক শিক্ষা কোর্সকে সংকুচিত করার তৎপরতা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ নভেম্বর-২০২২ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রম স্টিয়ারিং কমিটির’ দ্বিতীয় সভায় প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১০ মাস করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ৬ মাস প্রশিক্ষণ হবে পিটিআইয়ে এবং বাকি ৪ মাস প্র্যাকটিস টিচিং মানে ৪ মাসের প্রশিক্ষণ কাজটি হবে মূলত বিদ্যালয়ে (প্রথম আলো: ২১ জানুয়ারি-২০২৩)। প্রাথমিকে সিইনএড, ডিপিএড ছাড়াও আরও অনেক প্রশিক্ষণ আছে। যেমন বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ উপজেলা রিসোর্স সেন্টারগুলোতে প্রত্যেক শিক্ষককে দেওয়া হয়ে থাকে। দুঃখজনক বাস্তব ঘটনা হলো, এসব প্রশিক্ষণে শিক্ষকদেরকে যা শিখানো হয় তা মোটেই প্রয়োগ করা হয় না। অর্থাৎ শিক্ষকগণ শুধু প্রশিক্ষণে আসেন, প্রশিক্ষণভাতা পান কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়োগ করেন না। এতে সরকারের শুধু টাকা ব্যয় হয়- শিক্ষার্থীদের কোনো উপকার হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, প্রশিক্ষণ সেন্টারের পরিবেশ এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশ সমান নয়। ফলে কোনো কোনো শিক্ষক একান্ত ইচ্ছা থাকার পরও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন না।
যতদিন যাচ্ছে প্রাথমিকের সমস্যাগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম সমস্যা হচ্ছে জনবল সংকট। এই জনবল সংকটের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে তদারকি করা যাচ্ছে না। যে উপজেলায় ৮/১০ জন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার থাকার কথা সেখানে আছেন মাত্র ২/৩ জন। একজন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অধীনে ২০/২২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার কথা। সেখানে একজন সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে ৭০/৮০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তদারকি করতে হয়। একজন সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় একবার পরিদর্শন করার পর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে গেলেও তিনি ওই বিদ্যালয় আর পরিদর্শন করার সুযোগ পান না। এমতাবস্থায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কিভাবে দুর্নীতিমুক্ত হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি এসব সমস্যাবলী যখন আরও জটিল হচ্ছে তখন আরেকটি নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। আর এ নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এ বিষয়ে তাদের জারিকৃত নির্দেশনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারির আগে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়নি। সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করতে হলে আরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং বাড়াতে হবে ক্লাসরুমের সংখ্যাও। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক এবং ক্লাসরুমের সংখ্যা না বাড়িয়ে সকল বিদ্যালয়ে এক শিফট করার সিদ্ধান্ত বিষয়ক নির্দেশনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। একই আদেশে শিক্ষার্থী কম থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকটবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। কোমলমতি শিশু এবং প্রাক-প্রাথমিকের খুদে শিক্ষার্থীরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের পক্ষে ১ কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে গিয়ে ক্লাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ছাত্রীদের পক্ষে এত দূরে ক্লাস করাও সমভাবে কঠিন। কারণ সামাজিক নিরাপত্তার অভাব গ্রাম-শহর সর্বত্রই প্রকট। এমন সিদ্ধান্ত না পাল্টালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। দেশের হাওর-বাওড়, চর এবং পার্বত্য এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বাস্তবতা বর্জিত নির্দেশ বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাাঁড়াবে। শিক্ষার মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার সকল সমস্যার আশু সমাধান করতে হবে। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসা সরকারের মহান দায়িত্ব।
লেখক : কলামিস্ট।