ছোটদের ফররুখ
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২৩, ৫:৩৫:১০ অপরাহ্ন
আবু মালিহা
ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল। চিন্তা ও মননে ছিলেন তৌহিদবাদী। বিশ্বাস ও দৃঢ়তায় অকুতোভয়। কারো কাছে মাথা নোয়াননি। জীবনযুদ্ধে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে নিজেকে সত্যের স্বপক্ষে আদর্শিক সিপাহসালার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারো রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করেননি। সমকালীন অনেক বাঘা বাঘা কবি সাহিত্যিক তৎকালীন প্রশাসনের চাপে এবং বিরোধী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে নিজের আদর্শিক ভাবধারাকে উচ্চকিত রাখতে জুলুম সইতেও দ্বিধা করেননি। তিনি এমনই একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কবি ছিলেন, যার ফলে অনেকেই পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন নৈতিকতার দৃঢ়তার কারণে।
তিনি বরাবরই যুব সমাজের অধঃপতনরোধে নৈতিক সংস্কৃতি প্রসারে সদা উজ্জীবিত থাকতেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন সাহসী নাবিক। জাতিকে সর্বদাই সচেতন করেছেন। সোচ্চার থেকেছেন আত্মরক্ষার তাগিদে।
তাঁর একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা ছিল ‘পাঞ্জেরী’। তাঁর দিক নির্দেশনায় জাতির ভবিষ্যত এবং করণীয় সম্পর্কে সচেতন প্রহরীর মত জাতিকে আহবান করেছেন উত্থাল সমুদ্রের দিকবিহীন জাহাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করে জয়ের বন্দরে পৌঁছানোর জন্য। কতটুকু দেশপ্রেম, জাতির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করলে এমন কবিতা লেখা যায় এটার তাঁর অন্যতম নিদর্শন।
এ মহান কবির রচনাসমগ্র পাঠ করলে উপলদ্ধি করা যায় কত ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শিক চেতনা লালন করলে পরে এমন লেখা উপহার দেয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে নজরুলপরবর্তী সময়ে এমন সাহসী কবি খুব কমই নজরে পড়বে। রেনেসাঁ আন্দোলনের যে কয়জন কবি ছিলেন, কবি ফররুখ ছিলেন তাদের অন্যতম। ঈমানী দৃপ্ত চেতনায় জ্বলজ্বল করত তার অবয়ব। সত্যানুসন্ধ্যানী এবং ইসলামি জাতিস্বত্তার সংস্কৃতি লালনে তিনি বরাবরই ছিলেন আপোসহীন। তোষণনীতি ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ। নীতিনৈতিকতা এবং মুসলিম জাতিস্বত্তার সাংস্কৃতিক বিকাশে তিনি ছিলেন আপোসহীন যোদ্ধা। মানবিকতা ও পরধর্মে সহমর্মিতা তার কাজ বিশালতায় অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। মানুষের মর্যাদায় এবং মানবতার স্বপক্ষে তিনি ছিলেন লড়াকু সৈনিক। এ পথে চলতে গিয়ে তিনি অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবুও কারো কাছে নতিস্বীকার করেননি। নিজের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার উপর আঘাত সইতে পারতেন না। যার কারণে সকলের চোখেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর এ দৃঢ়তার কারণে সরকারি প্রশাসনের অনেক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে দুঃখ ও যন্ত্রণা ছিল তার নিত্যসঙ্গী।
কবি জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। সে সময়কালে তার সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল তোষোমোদপ্রিয় এবং লোভাতুর দৃষ্টিতে সাহিত্যকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলেন অনেক কবিসাহিত্যিক ক্ষুদ্র স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য। সে সময়েই তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা সাহসী নাবিকের মত উজ্জ্বল পথের দিশারী। সামাজিক কুসংস্কার এবং স্বার্থপরতার নাগপাশ ছিন্ন করে তিনি সুস্থ সংস্কৃতি এবং জাতি গঠনে আদর্শিক মানদন্ডে একদল লড়াকু সৈনিক তৈরি করতে তার মৌলিক সাহিত্যে সাধনার ক্ষেত্রে নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল অবিরাম। ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে মানবীয় চিন্তা চেতনায় জাতির দুঃসময়ে তিনি ছিলেন এক কান্ডারীর মত। যেখানে হাজারো মত ও পথ ছিল দিকভ্রান্ত সাংস্কৃতিক সয়লাব। সেক্ষেত্রে তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে বিশেষ করে মুসলিম জাতি সত্তাকে আদর্শিক চেতনায় লালন করার ক্ষেত্রে অবদান ছিল অতুলনীয়। ফলে বিশাল প্রতিভাসম্পন্ন একটি তৎকালীন বিরোধী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং অনেক নামী-দামী কবি সাহিত্যিকদের চক্ষুশূল ছিলেন। সাংস্কৃতিক ময়দানে নীতি নৈতিকতার একজন আদর্শ সৈনিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে তিনি অনেক শিশুতোষ অনেক গল্প কবিতা ও ছড়া লিখেছেন। যা আগামী দিনের সাহিত্য ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানে উপযোগী হতে পারে। সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিলÑ পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৬৮), নতুন লেখা (১৯৬৯), ছড়ার আসর (১৯৭০), চিড়িয়া খানা (১৯৮০), ফুলেল জলসা (১৯৮৫), সাত ডাকাত ও হাতেম তায়ী (২০০২) ও শ্রেষ্ঠ কিশোর সাহিত্য (২০১৯)।
সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে চিন্তা চেতনায় ও মননে তার বিকাশশীলতার স্ফুরণ থাকত। তিনি জানতেন আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই তিনি শিশুকিশোর ভাবনাতে তাদের চিরন্তন আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ছড়া, কবিতা ও বিভিন্ন গল্পে। শিশুদের আদর্শিক ভাবনাকে প্রকটিত করতে সুন্দর সুন্দর ছড়া কবিতা লিখে অনুপ্রাণিত করেছেন। সেগুলির মধ্যে ছড়ার আসর, পাখির বাসা, ফুলের জলসা, সাত ডাকাত আর হাতেমতায়ী গ্রন্থ পড়লে শিশুমনের ভাবনায় ভবিষ্যত প্রেরণার এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার আকাঙ্খাকে জাগরিত করে। যেমনি কথার ছড়া, ভাবের দ্যোতনা ও চিন্তার প্রসারতায় এসব কবিতা ও ছড়ায় ভাবনাগুলোকে উদ্বেলিত করে। তাছাড়া প্রকৃতির প্রেম ও সৌন্দর্য রূপকেও শিশুমনে রংধনুর মত রঙিন জীবনের প্রভাব ফেলে। সত্য ও সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট করে এবং প্রেমপ্রীতি ভালোবাসার নন্দন পরিবেশ সৃষ্টিতে দারুণ সহায়ক হয়। পবিত্র শিশুমনের রূপকে বাস্তব জগতের সাথে পরিচিত করতে সুন্দর সুন্দর কবিতা ছড়ার মাধ্যমে নিজেকে গড়ার প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছেন সহজ সরল ভাষায়। বিশেষ করে ইসলামী মূল্যবোধ ও জীবন আচরণে তার প্রভাব সৃষ্টিতে শিশুমনকে তিনি সযতেœ পথ দেখিয়েছেন আন্তরিক ভালোবাসা ও হৃদয় নিংড়ানো ¯েœহ পরশে। এ ব্যাপারে ‘ছোটদের ফররুখ’ নামের বইগুলোতে কবি শিশুকিশোরদের শত আকাঙ্খা ও ভবিষ্যতে আর্দশ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে তাঁর আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলো না। তাই তাকে শিশুদের ফরুরুখ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
শিশুমনকে আন্দোলিত করে এমন কয়েকটি ছড়া উল্লেখ করছি। বিশেষ করে বর্ণখচিত ছড়াগুলো বেশ মজার। যেমন: (১) অয়ে অতসী- তিমির মাঠ/ অশথ গাছের সামনে হাট/ অলি গলি শহর চাই/ অলি গলি শহর চাই। (২) আ য়ে আনারস, আম বাগান/ আসমানি রঙ ফুলটা আন/ আসমানি রঙ মন টানে;/ আ যেতে চায় আসমানে। (৩) (হ্রস্ব) ই কয় ইলশে গুড়ি/ ইলিশ মাছে ভারবে ঝুড়ি/ ইষ্টিশানে মিষ্টি পান/ ইলিশ কিনে গায় সে গান (৪) (দীর্ঘ) ঈ যায় ঈদগায়/ ঈদ এসেছে রাঙ্গা নায়/ নতুন চাঁদের বাঁকা নায়/ (দীর্ঘ) ঈ যায় ঈদগায়।
আরো আছে। যেমন: (১) কয়ের কাছে কলমি লতা/ কলমি লতা বায়না কথা/ কোকিল ফিঙে দূর থেকে/ কলমি ফুলের রঙ দেখে/ খ কে নিয়ে খেঁক শিয়ালি/ যায় পালিয়ে কুমার খালি/ পাখ পাখালি খবর পেয়ে/ খর শোসীকে দেয় জানিয়ে।
শিশুমনের নদীতে ঢেউ দিতে তিনি আরো অনেক লিখেছেন ছড়া ছন্দে শিশুমনকে আন্দেলিত করতেÑ যেমন: প- ভুলেছে পিঠাতে/ পিঠার সোয়াদ মিঠাতে/ পিঠা নিয়ে চলছি পুকুর পাড়ের ভিটাতে/ (২) ফ-য়ের কাছে ফলসা/ ফলসা গাছে জলসা/ জলসা হবে আজ যে/ ফিঙে পাখির রাজ্যে।
এভাবে অসংখ্য ছড়া কবিতা লিখে আমাদের শিশুকিশোরদের তিনি সরব রেখেছেন সাহিত্যের নন্দন বাগানে। যারা আগামী দিনে তারই মত সাহিত্য সংস্কৃতিতে উজ্জল তারকার মত যেন দীপ্তিমান হতে পারে।
এবার কবির শিক্ষা জীবন নিয়ে উল্লেখ করি। কবির ম্যাট্টিকুলেশন (১৯৩৭) আই এ (১৯৩৯) বিএ (ইংরেজী) স্কটিশ চার্চ কলেজ। বিএ অনার্স (দর্শন) কলকাতা সিটি কলেজ (১৯৪১)। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কর্মজীবনে যোগ দেন কলকাতা আইজি প্রিজন অফিস (১৯৪৩) কলকাতা সিভিল সাপ্লাই (১৯৪৪) ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহম্মদী (১৯৪৫), স্ক্রীপ রাইটার, গীতিকার এবং পরিচালক কিশোর মজলিশ, ঢাকা রেডিও বেতার (১৯৫২)।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদান এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্বরূপ সরকারি বেসরকারি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম; প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০) বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬১) আদমজী পুরস্কার (১৯৬৭), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৭) একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৪) ভাষাসৈনিক পদক (২০০০)।
এমন প্রতিভবান কবির সম্পর্কে জানা তার কাব্য সাহিত্য অধ্যয়ন করা দেশপ্রেমিক জনতা বিশেষ করে শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের পৃষ্ঠপোষকসহ কবি, সাহিত্যিক শিশুকিশোরসহ আমাদের সকলের অধ্যয়ন করা একান্ত অপরিহার্য। কবির দেশ প্রেম, সাহিত্যে তাঁর বিশাল অবদান এবং মানুষ সম্পর্কে তার ভালোবাসা বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি নিরন্তর গবেষণা ও চর্চা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবে। আজ সময় এসেছে কবির সাহিত্যসমগ্র পাঠ করে কবিকে বেশী করে জানার এবং শিশুকিশোরদের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসার যে চিত্র ছড়া সাহিত্যে প্রকাশ করেছেন, তা সকলের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ মহান কবির সাহিত্য সাধনার প্রভাব আগামী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ুক এই প্রত্যাশা।