বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ
‘শেষকৃত্যের আয়োজন’ গোয়াইনঘাটের হিদাইরখাল নদীর
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২৩, ৬:১৭:৫০ অপরাহ্ন
নদীর বুকে বাঁধ, তার উপরে পাকা রাস্তা করার উদ্যোগ
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার হিদাইখাল নদীর প্রবাহ বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয়ার পর এখন সেই বাঁধের উপর পাকা রাস্তা নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। নদীর হত্যার পর এটা শেষকৃত্যের আয়োজন বলে মন্তব্য পরিবেশবাদীদের। অবিলম্বে বাঁধ অপসারণ করে নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা ও ‘নদী হত্যা’র সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ তাদের। স্থানীয়রাও বাঁধ অপসারণ করে সেখানে ব্রিজ নির্মাণের দাবি তুলেছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গোয়াইনঘাট উপজেলার মঞ্জিলতলা ও কাকুনাখাই এলাকায় সারি নদী থেকে হিদাইরখাল নদীর (বাউলিখাল নদী) উৎপত্তি। উৎসস্থল থেকে নদীটি অনেকগুলো হাওর-বাওর-বিল-জনপদ অতিক্রম করে ‘বেকরা’ নাম ধারণ করে। পরে ফতেপুর ইউনিয়নের মানিকগঞ্জ বাজারে কাপনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে রাতারগুল জলারবনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পুনরায় সারি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি যাত্রা পথে অনেকগুলো ছোট-বড় খালের সাথে যুক্ত হয়েছে। প্রায় ২০০ ফুট প্রস্থের প্রমত্তা নদী হিদাইরখাল পাহাড়ি ঢল ও বর্ষায় স্থানীয় নদ-নদী ও হাওরের পানি প্রবাহের অন্যতম মাধ্যম বলে জানান স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালে হিদাইখাল নদীর উৎসমুখে নদীর গতিপথ রোধ করে আড়াআড়ি বাধ নির্মাণ করা হয়। নদীর এক পারে কাকুনাখাই; অপর পারের হুদপুর গ্রামের মধ্যে নদী ভরাট করে বিশাল বাধ নির্মাণ করে নদীর প্রবাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে নদীর গতিপথ রোধ করে নির্মিত বাঁধ অন্য রাস্তার সাথে যুক্ত হয়ে আটলিহাই-নাইন্দার হাওর রাস্তার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নদীর গতিরোধ করে নির্মিত বাঁধের উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তা পাকা পাকাকরণের দরপত্র (টেন্ডার) আহŸান করেছে। সেখানে সাড়ে ৮ কিলোমিটার সড়ক পাকাকরণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ কিলোমিটার ৮ ২ এর পৃ. ১ ক. দেখুন
পাকাকরণের টেন্ডার হয়েছে। পাকা সড়ক নির্মিত হলে এটি মরা নদীতে পরিণত হবে এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে আশংকা পরিবেশবাদীদের।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে স্থানীয় জনসাধারণ, পরিবেশবাদী ও সচেতন মহল জানিয়েছেন, নদী বাঁধ দিয়ে আটকে দেয়ার ক্ষতিকর প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। পাহাড়ী ঢলের সময় সারি নদী দিয়ে আসা পানির প্রায় এক তৃতীয়াংশ হিদাইখাল দিয়ে প্রবাহিত হত। পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বর্তমানে পাহাড়ি ঢলের সময় সারি নদীর পানির উচ্চতা কয়েক মিটার বেড়ে যায়। পানির স্থায়িত্বও বেড়ে যাওয়ায় নদী ভাঙ্গণের তীব্র ছোবল দেখা দিচ্ছে। এ বাঁধ নির্মাণের আগে পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানি ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যেই নিচু এলাকায় প্রবাহিত হতো। এখন সে পানি প্রবাহে সময় লাগছে কয়েকদিন।
এদিকে, হিদাইরখাল নদীতে বাঁধ দেয়ায় আশাপাশের কাপনা, বেকরা নদীসহ অন্যান্য নদীতে পানি প্রবাহেও পরিবর্তন এসেছে। এসব নদী তার চিরচেরা রূপ হারিয়ে ফেলেছে। স্থানীয় ৩৪টি হাওর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান তারা। নদী ও হাওরের পানি প্রবাহের পরিবর্তনের ফলে খলাগ্রাম, বিড়াখাই, হাটিরগ্রাম, গাথি, চাতলারপারসহ আশপাশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন।
পরিবেশ কর্মী ও নদী গবেষক আব্দুল হাই আল হাদি জানান, নামের সাথে ‘খাল’ শব্দটি থাকলেও আদতে এটি একটি প্রমত্তা নদী। স্থানীয় একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে স্থানীয়দের ভুল বুঝিয়ে পরিবেশ ও এলাকার এক অপূরণীয় ক্ষতি করছে। একটি প্রবাহিত বড় নদীর উপরে বাঁধ দিয়ে সম্পূর্ণ নদীর গতিপথ রোধ করে দেওয়া হলো। কিন্তু, সংশ্লিষ্টরা তা দেখতে পেলো না-বিষয়টি কারো বোধগম্য নয়। পরিবেশ কর্মীদের পক্ষ থেকে অনেকবার আবেদন করে নদীটি রক্ষার জন্য অনুরোধ জানানো হলেও কোন কাজ হয়নি। নদী রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর, এলজিইডি, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কার্যক্রমে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ জানান, নদীর পানি প্রবাহ কোন ভাবেই বন্ধ করা যাবে না। স্থানীয়দের মারমুখী আচরণের কারণে তারা প্রথমে হিদাইখালের সার্ভে পর্যন্ত করতে পারেননি বলে জানান তিনি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্থানীয়দের বুঝিয়ে সার্ভে করার সুযোগ করে দেন। তারা সার্ভে রিপোর্টসহ একটি প্রস্তাব
মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। প্রস্তাবে নদীর বাঁধ অপসারণ করে সেখানে একটি ক্লোজার বা ¯øইস গেইট নির্মাণের প্রস্তাব করেছেন। এলজিইডি’র বাঁধ পাকাকরণের উদ্যোগের বিষয়টি শুনেছেন জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, আগামী জেলা সমন্বয় সভায় তিনি বিষয়টি উত্থাপন করবেন। পাকাকরণ হয়ে গেলে বাঁধ অপসারণ আরো কঠিন হয়ে যাবে বলে তার মন্তব্য। রাতারগুলসহ বিশাল এলাকার পানি প্রবাহ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান বলেছেন, এলজিইডি ঐ এলাকায় একটি রাস্তা পাকাকরণের কাজ করছে মর্মে শুনেছি। কিন্তু রাস্তাটি নদীর উপর দিয়ে গেছে কিনা জানি না। পাকাকরণ হলেও পরে ব্রিজের অনুমোদন পেলে বাঁধ অপসারণ করা যাবে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।
গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলী রফিক আহমদ জানান, তারা বাঁধের অংশে কাজ করবেন না। বাঁধের পূর্বের অংশ কাজ করবেন।
এলজিইডি,সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইনামুল কবীর নদীর গতিরোধ করে এমন যেকোন কাজের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা তুলে ধরে বলেন, নদীর অংশে কোন কাজ এলজিইডি করবে না। নদীর উপরে ব্রিজ করার বিষয়টি অনুমোদিত হলে আমরা তা করে দিতে পারি।
নদীর উপরে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহ একেবারেই বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক এমরান হোসেন জানান, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।