চলে গেলেন গরিবের ডাক্তার
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুন ২০২৩, ১:৫১:২৯ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
ডা. এম. এ. কুদ্দুস আর ইহজগতে নেই। রোগীরা তার মুখে প্রায়ই একটি কথা শুনতেন ‘আল্লাহ ভরশা’। রোগী দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে হাতে দিয়ে বলতেন আল্লাহ ভরসা, যান ভালো হয়ে যাবেন। আল্লাহর ওপর তার অগাধ ভরসা ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তিনি চিকিৎসা করতেন। তিনি যেমন বিত্তবানদের চিকিৎসা করতেন তেমনি গরিব রোগীদের অত্যন্ত দরদ দিয়ে দেখতেন। তাঁর নির্ধারিত ফিস ছিল, কিন্তু গরিব রোগীদের বেলায় তাতে কড়াকড়ি ছিল না। এই গরিবদরদি ডাক্তার ধনী-গরিবের ডাক্তার গত ১২ এপ্রিল (বুধবার), ২০২৩ না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
আমি ডা. কুদ্দুসকে কুদ্দুস ভাই ডাকতাম, তিনি আমাকে দুলাভাই বলে ডাকতেন। তিনি ছাত্র জীবনে এবং ডাক্তার হওয়ার পর প্রথমদিকে শাহী ঈদগাহ মহল্লায় আমার শ্বশুর বাড়ির পাশাপাশি বাসায় থাকতেন এবং আমার শ্যালক-শ্যালিকাদের সঙ্গে তার খুব হৃদ্যতা ও দহরম-মহরম গড়ে ওঠেছিল। যেকোন অনুষ্ঠান আপ্যায়নে কুদ্দুস ভাইরা যুক্ত থাকতেন। সেই সূত্রে আমাদের বাসার সঙ্গেও কুদ্দুস ভাই’র ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠেছিলো। ক্রমে ক্রমে এই ঘনিষ্টতা আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্ক ‘ডাক্তার-রোগী’ সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হয় আমাদের সম্পর্ক।
কুদ্দুস ভাই শিশু-কিশোরদের খৎনা দিতেন। তিনি অত্যন্ত দরদ দিয়ে কথা বলতে বলতে গল্পচ্ছলে খৎনার কাজ শেষ করতেন যে রোগীরা টেরই পেতো না। তিনি খৎনা শেষ করে পট্টি বেঁধে হেসে হেসে বলতেন এখন কাটবো নাড়াচাড়া করো না। এরপর বলতেন যাও হেঁটে হেঁটে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।
কুদ্দুস ভাই’র মৃত্যুর ৪২ দিন আগে আমি বাথরুমে পড়ে যাই। বেখেয়ালে পা পিছলে যায়, আমি সাওয়ারের নব আঁকড়ে ধরলে নব ভেঙ্গে আমার হাতে চলে আসে। আমি ছিটকে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে যাই এবং কোমরে বাম পাছার নিচে উরু’র জয়েন্টে প্রচন্ড আঘাত পাই। বিদঘুটে ব্যথার সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারতাম না। বন্ধু বান্ধব যারা দেখতে এলেন, সবাই বললেন সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে এবং নড়াচড়া না করতে। কুদ্দুস ভাইকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, দ্রুত চেম্বারে চলে আসেন। চেম্বারে গেলে তিনি আমাকে উঠ-বস করালেন ও মাজায় চাপ দিলেন। বললেন, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেন এবং শুয়ে থাকবেন না। ৪/৫ দিন পর আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম, তিনি পায়ে টানা দিয়ে আমাকে শুয়ে থাকতে বলবেন। তিনি এরকম কিছু বললেন না। আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই ছিলেন কুদ্দুস ভাই, এই ছিলেন আমার পারিবারিক চিকিৎসক ডা. এম. এ. কুদ্দুস। আমার পরিবার আমার নিকট আত্মীয়দের চিকিৎসা বিষয়ক গার্ডিয়ান ছিলেন তিনি। তিনি সাধারণত চেম্বারের বাইরে কোথাও কোনো কল-এ যেতেন না। তবুও ২/১ বাসায় যেখানে না গেলে না হয়, সেখানে যেতেন এবং সেই ২/১ বাসার মধ্যে আমার বাসাও একটি। তাঁকে হারিয়ে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি, এতিমের মতো হয়ে গেছি।
রোগ-রোগী-ডাক্তার-চিকিৎসা বিষয়ে কোথাও কোনো কথা হলে, আলাপ ওঠলে আমরা তৎক্ষণাৎ কুদ্দুস ভাই’র কথা বলতাম। এতে আমাদের ভাগনা মারুফ জাহান মারুফ বলতো মামা-মামীর কথায় বুঝা যায় সিলেটে ডাক্তার কুদ্দুস ছাড়া আর ডাক্তার নেই; সে বিরক্তই হতো। যখন কুদ্দুস ভাই চলে গেলেন তখন প্রায় সারা শহরে তাঁর জন্য হাহাকার রব ওঠলো, তখন মারুফ আশ্চর্য হয়ে যায় এবং বলে, সারা শহর ডা. কুদ্দুসের জন্য হাহাকার করছে, শোক করছে, কান্নার রোল ওঠছে। আর কোনো ডাক্তারের এমন জনপ্রিয়তা দেখিনি। কুদ্দুস ভাই এমন জনপ্রিয়তা নিয়ে থাকুন, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে পরকালেও ভালো থাকুন, জান্নাতের সুবাতাস-সুগন্ধি নিয়ে শুয়ে থাকুন, মহান রাব্বুল আল-আমীন আল্লাহ আপনাকে বেহেস্তী হিসেবে কবুল করুন।
কুদ্দুস ভাই’র অসংখ্য রোগী ছিল। সিলেট শহর ও শহরতলীতে, গ্রামাঞ্চলে তাঁর রোগী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তিনি রোগী দেখে ওষুধ লিখে দিয়ে বলতেন আল্লাহ ভরসা রোগ সেরে যাবে, ভালো হয়ে যাবেন। তাঁর রোগীদের তাঁর ওপর অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। সকল রোগীই উপকার পেতো, ভালো হয়ে উঠতো। কুদ্দুস ভাই’র দুই জন এটেনডেন্টস বা সাহায্যকারী ছিল তাদের ওপর তাঁর নিখাদ বিশ্বাস ছিল। আব্দুল মতিন সিরিয়েল দেখে রোগী ভিতরে পাঠাতেন এবং ফিস আদায় করতেন। চেম্বার বন্ধ করার আগে প্রাপ্ত ফিসের টাকার বান্ডিল কুদ্দুস ভাই’র হাতে তুলে দিতেন। তিনি না গুণে না দেখে টাকা ব্যাগে পুরে চলে যেতেন।
আরেকজন সাহায্যকারী ছিল ধীরেশচন্দ্র দাস। সে ব্লাডপ্রেসার মেপে টুকা লিখে কুদ্দুস ভাইকে দিত এবং নিজস্ব যন্ত্রে ডায়াবেটিস দেখে দিত। ধীরেশ নির্দিষ্ট কয়েকটি বাসায় নিয়মিত ডায়াবেটিক বা ব্লাড সুগার মেপে দিত এবং রোগী ও কুদ্দুস ভাই’র মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতো। কুদ্দুস ভাইকে হারিয়ে আমি যেমন অসহায় হয়ে পড়েছি, তেমনি দুই এটেনডেন্টসও অসহায়ত্ব অনুভব করছে। কুদ্দুস ভাই অত্যন্ত দরদ দিয়ে সময় দিয়ে রোগী দেখতেন। জটিল রোগের রোগীদের দীর্ঘ সময় দেখতেন, সন্তুষ্ট হয়ে তবে প্রেসক্রিপশন লিখে দিতেন। বলতেন আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঔষধ খাবেন, সুস্থ হয়ে যাবেন। কুদ্দুস ভাই’র এই দরদি কথায় রোগীর মনোবল বেড়ে যেতো, মনের ওপর প্রভাব পড়তো। রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যেতো। কুদ্দুস ভাইকে হারিয়ে মনে হচ্ছে আমিই হয়তো তাকে বেশি হারিয়েছি। কারণ তাঁর ওপর আমার নির্ভরতা এমনই যে মনে হচ্ছে আমার নির্ভরতা সীমাহীন, আমি যেনো অসহায় হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে আমি এমন কিছু হারিয়েছি যা ফিরে পাবার নয়। আমি অনেক প্রয়োজন মোবাইলে সেরে ফেলতাম। রাত ১২টা ১টায়ও আমি তাকে ফোন দিতাম এবং তিনি সাড়া দিতেন। চির পরিচিত কন্ঠে বলতেন কি সমস্যা। সমস্যা শুনে প্রতিকার বলে দিতেন।
কুদ্দুস ভাই’র দেশের বাড়ি ঢাকার ধামরাই। ছাত্রজীবন থেকে সিলেটে থাকতে থাকতে সিলেটী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় নিজ গ্রামে একটি মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি দুনিয়ায় না থাকলেও মাদ্রাসা তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তাঁর স্ত্রী শামীমা রসুল, অধ্যাপক এমসি কলেজ, সিলেট। তাঁদের একমাত্র সন্তান হামজা স্কুলে পড়ছে।
ডা. এম. এ. কুদ্দুস এমবিবিএস, এমফিল (এনাটমি) জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, সিলেট-এর অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
লেখক : সাবেক শিক্ষক, সিনিয়র কলামিস্ট।