নি:স্ব করে দিলো যাদের
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জুন ২০২৩, ৬:২৪:০৮ অপরাহ্ন
![নি:স্ব করে দিলো যাদের নি:স্ব করে দিলো যাদের](https://sylheterdak.com.bd/wp-content/uploads/2023/06/Sylheter-Dak-Logo-768x331.jpg)
নূর আহমদ :
দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের সকলেই ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষ। সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লায় হাওরে কৃষিকাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ ছিলো যাদের জীবন সঙ্গী। এরমধ্যে অনেকেই কাজের জন্য পরিবার পরিজনকে নিয়ে সুখে থাকার জন্য ছুটে এসেছিলেন সিলেট নগরীতে। সেখানেও এসেও কঠিন সংগ্রামে নেমেছিলেন তারা। কাজ নিয়েছিলেন নির্মাণ শ্রমিকের। ভোর হওয়ার আগেই নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকতেন। গতকাল বুধবার জীবন সংগ্রামের ইতি টেনে পাড়ি দিয়েছেন পরপারে। একটি দুর্ঘটনা পুরো পরিবারকে স্তব্দ করে দিয়েছে। থমকে গেছে জীবন যাত্রা। এমন সব ঘটনা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
শারমিনের যেন সুখ সইছে না : সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত দুলাল মিয়ার ফুফাতো ভাই মো. শাহীন। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছেন পাশে থাকা স্বজনরা। নিহত দুলাল মিয়া (২৫), সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে।
মো. শাহীন জানান, দুলালের বড় ভাই হেলাল আহমদ প্রায় তিন মাস আগে নৌ দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে যান। মাসখানেক আগে পরিবারের লোকজন হেলালের স্ত্রী শারমিন বেগমকে (২৫) বিয়ে দেন দুলাল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর কাজের জন্য সিলেটে আসেন দুলাল। থাকতেন আম্বরখানা ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকার ভাড়া বাসায়। গতকাল বুধবার দুলালও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। প্রথম স্বামীর শোক কাটতে না কাটতেই ২য় স্বামীও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এখন শারমিনের চোখে কেবল অন্ধকার।
বিয়ের পিঁড়িতে বসা হল না সৌরভের : ছেলে সৌরভ (২৭) কে হারিয়ে মা আমিনা বেগম বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন। সৌরভের বাবা সিরাজ মিয়াও এসেছিলেন হাসপতালে। তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। বাবা- মা বার বার নিজেদের সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করলেও পারছিলেন না। কান্না জড়িত কন্ঠে মা আমিনা বেগম বলে উঠেছিলেন ‘আমার পুতরে (ছেলে) বিয়া করাইতে আসলাম, মেয়ে দেখি রাখছিলাম গো। আমার পুতের কিতা হইল, তোমরা আমার পুতরে আনি দেও।’
বাবা-মা জানান, সাত দিন আগে বেড়ানোর কথা বলে সিলেটে এসেছিলেন সৌরভ মিয়া (২৭)। পরে বাড়ির লোকদের না জানিয়ে পরিচিতজনদের সাথে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লেগে যান। আর তার গ্রামের বাড়িতে বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ করে রেখেছিলেন মা আমিনা বেগম। কিন্তু কে জানতো সৌরভ বাড়িতে ফিরবে লাশ হয়ে। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ছেলের কথা ভেবে বার বার মুর্চ্ছা যাচ্ছিলেন মা-বাবা।
মেয়ের বিয়ের ঋণের টাকা পরিশোধ করবে কে? : সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ মিয়া (৫০)ও গতকাল বুধবার এ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। নিহত রশিদ মিয়ার স্ত্রী রাফিছা বেগম জানান, ছয় মাস আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়ের বিয়ের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে রশিদ শনিবার সিলেটে আসেন। এরপর টাকার জন্য ছাদ ঢালাইয়ের কাজে যোগ দেন। পরিবারে আয় করার মতো আর কেউ নেই। এখন এই ঋণ পরিশোধ করবে কে?
‘আমারে আর ফ্যান কিনে দিতে পারলো না’ : হিমঘরের পাশে মাটিতে বসে আহাজারি করছিলেন মেহের মিয়ার স্ত্রী চাঁদনী বেগম। আহাজারি করে তিনি বলেন, সকালে ডিম রান্না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না খেয়েই চলে যায়। এখন আমার বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে গেলো। আমি টাকা চাই না। বাচ্চাদের বাবাকে চাই।
কাঁদতে কাঁদতেই চাঁদনী বলেন, ‘গরমে কাল রাতে ঘুম আসছিল না। রাত দুইটার দিকে সে আমারে ডাক দেয়। বলে- তোর জন্য একটা ফ্যান কিনে দেবো। আমারে আর ফ্যান কিনে দিতে পারলো না।’
মেহেরের শাশুড়ি হাফিজা বেগম বলেন, মেহেরের সঙ্গে থাকা লোকজনের মাধ্যমে খবর পান সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মেহেরকে ওসমানী হাসপাতালে আনা হয়েছে। হাসপাতালে এসে জানতে পারেন মেহের মারা গেছে। তিনিও কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন- এখন তার মেয়ের কি হবে। কারা দেখবে তাদের, এ কথা বলতে বলতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। তখন পাশে থাকা আরেক নারী হাফিজা বেগমকে ধরে রাখেন।
মানবিক অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরা : বিনামূল্যে মরদেহগুলো বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরা। লাশগুলো বিনা মূল্যে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল ওসমানী হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস উপকমিটি। এই মানবিক কাজে প্রশংসিত হচ্ছেন তারা।
গতকাল বুধবার বেলা দুইটা থেকে লাশগুলো হস্তান্তর শুরু হয়। অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরা হাসপাতাল এলাকা থেকে বেলা তিনটার দিকে মরদেহসহ স্বজনদের নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে রওনা হন। ওসমানী হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস উপকমিটির সহসভাপতি শরিফ আহমদ চৌধুরী বলেন, স্ট্যান্ডের পরিবহন শ্রমিকেরা নিজেদের ইচ্ছাতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বিনা মূল্যে মরদেহ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। নিহত সব শ্রমিকই নিম্ন আয়ের। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। আবার কিছু একই জেলার সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার এবং নেত্রকোনা জেলারও রয়েছেন।
শরিফ আহমদ জানান, সাধারণত এসব লাশ পরিবহন করতে সাড়ে তিন হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন চালকেরা। তবে মানবিক দিক বিবেচনা করে কোনো খরচ কিংবা টাকা ছাড়াই পরিবহন করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।