পলো, বাওয়া
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০২৩, ৬:১৫:৫২ অপরাহ্ন
রফিকুর রহমান লজু
‘পলো’ নামটা খুব সুন্দর। পলো হলো মাছ ধরার এক রকম যন্ত্র। বাঁশের চিকন শলা দিয়ে পলো তৈরি করা হয়। পলো যারা তৈরি করে তাদের কারিগর বা শিল্পী বলা হয়। ফরিদপুর জেলার বুকাইল গ্রামটি পলো’র জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামের নাম পলোডাঙ্গা হয়েছে পলোর নামে। সিলেট জেলার মৌলভীবাজার, বালাগঞ্জ প্রভৃতি স্থানেও পলো তৈরি হয়।
বেতু বা বেতুয়া বাঁশ দিয়ে পলো তৈরি করতে হয়। এই বাঁশ একটু নরম বিধায় পলো তৈরির কাজে লাগে। বাঁশের শলা আগুনে সেঁধে বিশেষ আকৃতি করা হয়। মধ্যে মধ্যে অনেকগুলো গিরো দিয়ে শলাগুলো আটকাতে হয়। এই গিরোর জন্য গল্লাবেত বা সুন্দিবেত প্রয়োজন হয়।
হাওরে, বিলে, দীঘিতে এবং বড় পুকুরে মাছ ধরতে পলো ব্যবহৃত হয়। মাছ ধরতে অনেক লোক এক সঙ্গে পানিতে নামে। কেউ একটি মাছ আটকালে চারদিকে আনন্দ-চিৎকার ওঠে। পলো দিয়ে মাছ ধরা গ্রামে গঞ্জে একটি আনন্দানুষ্ঠান। ছোট-বড় এবং মহিলারাও পলো বাওয়া দেখতে দীঘিপাড়ে- পুকুর পাড়ে সমবেত হয়। যারা মাছ ধরলেন এবং যারা মাছ ধরতে পারলেন না, তাতে কিছু যায় আসে না। সবাই মাছের অংশ পায়। মাছধরা পর্ব শেষ হয়ে গেলে কিশোর-যুবকরা মাছ ধরতে নামে। এ সময় আর মাছ বাট বা অংশ করা লাগে না।
অতঃপর মাছ কেটে-কুটে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। উনুনে আগুন দিয়ে রান্না বসানো হয়। রান্না হয়ে গেলে খাওয়ার আয়োজন করা হয়। মাছ ধরা উপলক্ষে ঘরে ঘরে মেহমান থাকে। মেহমানদের নিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে খাওয়া হয়। এই খাওয়ায় কোনো পরিমাণ নেই যা ইচ্ছে খেতে পারেন। বন্ধুর বাড়িতে আত্মীয়ের বাড়িতে মাছ পাঠানো হয়।
শো-পিস হিসেবে বাড়িতে পলো রাখা হয়। হাঁস-মোরগ ধরে রাখতে পলো ব্যবহৃত হয়। পলোর একটা বড় উপকারিতা আছে। আগে যখন রাস্তাঘাট ভালো ছিলো না, গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ছিলো না, তখন মাছ ধরার পলোই ছিলো ভরসা। রোগীকে পলোর ভিতরে বসিয়ে শিকের মতো ঝুলিয়ে দুইজনে নিয়ে যেতেন ডাক্তারের কাছে। রোগীকে পলো থেকে নামানো হতো না, ডাক্তার ওঠে এসে রোগী দেখতেন ও ব্যবস্থাপত্র দিতেন।
ঘরে ড্রয়িং রুম সাজানোর জন্য ছোট ছোট পলো এনে দর্শনীয় স্থানে লটকানো হয়। সুবিধা থাকলে পলোর ভিতরে ডিম লাইট লাগানো হয়। ভিন্ন ভিন্ন রঙের লাইটে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। রাতে বাইরে থেকে দেখলে ঘরকে স্বপ্নপুরী মনে হবে।
প্রায় দুইশত বছরের ঐতিহ্য
পলো বাওয়া উৎসব গ্রাম গঞ্জের একটা পুরোনো উৎসব। বিশ্বনাথের গোয়াহরি গ্রামের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রায় দু’শ বছরের অধিককাল ধরে বাংলা সনের প্রতি মাঘ মাসের পহেলা তারিখে এই পলো বাওয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রায় দু’ঘন্টা ধরে এই উৎসব চলে। গ্রামবাসী পূর্ব পুরুষদের আমল থেকে এই উৎসব পালন করে আসছেন। উৎসবের এ সপ্তাহ পূর্বে পঞ্চায়েত ডেকে শৃঙ্খলা রক্ষায় নেয়া হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। এই উৎসব চলবে পনের দিন পর্যন্ত। প্রতি বৃহস্পতিবার ও রোববার হাত দিয়ে মাছ ধরা হয়। প্রতি বছর পলো বাওয়া উৎসব দেখতে ও অংশ নিতে গ্রামের অনেক প্রবাসী দেশে আসেন।