সড়ক আইনের বাস্তবায়ন চাই
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০২৩, ৬:২৯:৪৬ অপরাহ্ন
মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী
এত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরও উপেক্ষিত সড়ক পরিবহন আইন। প্রতিদিন সড়কে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। খালি হচ্ছে মায়ের বুক। বিধবা হচ্ছে নারী। এতিম হচ্ছে শিশু। কিন্তু এই প্রাণহানি যেন নিয়তি হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ গত ৭ জুন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার নাজির বাজারে ট্রাক ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঝরে গেল ১৪টি তাজা প্রাণ। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে আজ তাদের স্ত্রী সন্তানরা কাঁদছে।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। দিনে অন্তত তিনজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে। সবার জন্য সড়ক নিরাপদ করতে চার বছর আগে ২০১৮ সালে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছিল। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি। সড়ক নিরাপদ হওয়ার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী গত বছর সড়কে ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ডিসেম্বরে। আর সংখ্যার দিক থেকে তুলনামূলক কম মৃত্যুর ঘটনা এপ্রিলে ৬৩ জন। বিদায়ী ২০২২ সালের মে, জুলাই, অক্টোবর ও ডিসেম্বর- এই চার মাসের প্রতি মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে মে মাসে ১০৭ জন, জুলাইতে ১০৪ জন এবং অক্টোবরে ১২৩ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। এদের বড় অংশের মৃত্যু হয়েছে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায়।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য, সড়ক দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে যত তর্কবিতর্ক, পরামর্শ, আলোচনা- এর প্রায় সবই রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকায় বসেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার পরামর্শ দেন এমপি, মন্ত্রী এবং সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। অথচ ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলেছে। গত বছর সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ২৭ শতাংশই হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এমনকি দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ঢাকার সড়কেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু- দুটিই এখন সর্বোচ্চ। সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে, বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের উদ্যোগে উদাসীনতা দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কারণে এখানে জনস্বার্থ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সিংহভাগই হতদরিদ্র, নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যায়, অনাহারে অর্ধাহারে এসব পরিবারের সদস্যদের দিনাতিপাত করতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ভুক্তভোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। আর দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে ভুক্তভোগী তিন লাখ টাকা সহায়তা পাবেন। এসব বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বিধিমালা জারি করা হয়েছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ এ বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সড়ক পরিবহন আইনটি হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আর এ আইন হওয়ার চার বছরের বেশি সময় পর হলো বিধিমালা। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের আন্দোলনের ফলেই নতুন সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে। সড়ক পরিবহন বিধিমালা অনুযায়ী, চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব না হলে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে তিন লাখ টাকা। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এক লাখ টাকা। ক্ষতিপূরণের দাবিগুলো ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য ফরম অনুযায়ী, দুর্ঘটনা ঘটার সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন দাখিল করার তারিখ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বোর্ডের চেয়ারম্যান অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন বোর্ডের কাছে দেবে। প্রতিবেদন দাখিলের ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড আবেদন মঞ্জুর পূর্বক আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিআরটি-এর চেয়ারম্যান এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন। আর্থিক সহায়তার টাকা আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে ‘প্রাপকের হিসাবে প্রদেয়’ চেকের মাধ্যমে দিতে হবে।
বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, এ আর্থিক সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল থাকবে এবং এই তহবিলে মোটরযান মালিক প্রতিটি মোটরযানের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা দেবেন। এ তহবিল গঠনে মোটর সাইকেলের মালিককে এককালীন এক হাজার টাকা দিতে হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের জন্য বার্ষিক দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপের জন্য বার্ষিক ৭৫০ টাকা দিতে হবে। কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য বার্ষিক ৫০০ টাকা করে দিতে হবে। আর থ্রি হুইলার ও অন্যদের বার্ষিক ৩০০ টাকা করে দিতে হবে। মোটর সাইকেল ছাড়া অন্যান্য যানের চাঁদা দেয়ার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে গেলে প্রতি মাস বা মাসের অংশ বিশেষের জন্য ৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হবে। তবে সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড প্রয়োজনে এই চাঁদার পরিমাণ কমাতে বা বাড়াতে পারবে। বিধিমালা অনুসারে, চালকের লাইসেন্সের জন্য ১২ দোষসূচক পয়েন্ট’ থাকবে। সড়ক পরিবহনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের কারণে ১ বা ২ পয়েন্ট কেটে নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যদি একজন চালক সব পয়েন্ট হারান, তবে তাঁর লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ২০ বছরের নিচে কেউ যানবাহনের কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজারের লাইসেন্স পাবেন না। আর এই লাইসেন্স পেতে হলে কন্ডাক্টরকে অবশ্যই পঞ্চম শ্রেণি এবং সুপারভাইজারকে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে (প্রথম আলো: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩)।
বাইরে বের হলে প্রিয়জন যেন নিরাপদে ঘরে ফেরে- দেশের মানুষের সহজ প্রত্যাশা হলেও বাস্তবে দিন দিন সড়ক বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। মূলত শাসনহীন সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের মহামারী কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। সড়ক নৈরাজ্য কেন হয়, কী করলে শৃঙ্খলা ফিরবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে উপদেশ-পরামর্শ কম বর্ষিত হয়নি। এরপরও সড়কে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা বেড়েছে বহুগুণ। সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময়ে নানা নির্দেশনাও জারি হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা কথার কথা হিসেবে থেকে যাচ্ছে। সরকার নিজে আইন প্রণয়ন করে তার সঠিক বাস্তবায়ন করছে না। সরকারের সদিচ্ছা এবং সড়ক আইন বাস্তবায়ন করলেই সড়কে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট