আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক উন্নয়ন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুন ২০২৩, ২:২৩:১৩ অপরাহ্ন
আবু নছর মোহাম্মদ সুফিয়ান
এই করোনা পরবর্তীকালে লেখার কারণ হল বর্তমানে আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। আর এ কঠিন সময়ে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করে চলমান পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার দক্ষতা অর্জন করা খুবই জরুরি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাভূক্ত ১০টি জীবন দক্ষতার অন্যতম মৌলিক দক্ষতা হল আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা। আন্তঃব্যক্তিক বলতে দুই/ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক বুঝায় (the word ÔinterÕ means Ôbetween)| । তাই আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক বলতে একজন ব্যক্তির এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক বুঝায়। এটাকে ইংরেজিতে বলে Interpersonal skill. লক্ষ্য আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার (Interpersonal skill) সাথে অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার (Intrapersonal Skill) সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। অন্তঃব্যক্তিক (Intrapersonal) বলতে বুঝায় নিজের মধ্যে (within the self) । যেযোগাযোগ ব্যাক্তির অভ্যন্তরে সংঘটিত হয় তাই অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। আর এটি একটি দক্ষতা (Skill)| । এর মধ্যে রয়েছে আত্মকথন, আত্মধারণা, আত্মপর্যবেক্ষণ, আত্মবিশ্লেষণ, আত্মশৃংখলা, অন্তর্দৃষ্টি ইত্যাদি। এছাড়া অন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা দ্বারা বুঝায় নিজের আবেগ, চাহিদা, ভাল লাগা, প্রেষণা ইত্যাদি নিজেই বুঝতে পারার দক্ষতা। কোন সমস্যা নিয়ে নিজের মনের গভীরে যখন আমরা নিজের সাথে নিজেই আলাপ-আলোচনা (self-communication) করে একটা বোঝা পড়ায় আসি সেটাই অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। এটাকে ইংরেজিতে বলে Intrapersonal Skill আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা হচ্ছে অন্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও তা বজায় রাখার সামর্থ্য এবং সম্পর্কছেদ করতে হলে ঝগড়া বা দ্বন্দে না গিয়ে গঠনমূলকভাবে সম্পর্কের ইতি টানার সামর্থ্য। তাছাড়া অন্যকে ভাল কাজে প্রভাবিত করার ক্ষমতা বা এডভোকেসি, অন্যের কাজ ও অবদানকে সম্মান প্রদর্শন করা, অন্যের কথাগুলো সক্রিয়ভাবে শোনা এবং কথার মেসেজগুলো গ্রহণ করা, ফিডব্যাক দেওয়া ও গ্রহণ করা, সক্রিয় শ্রবণ, সহযোগিতামূলক মনোভাব ও টিমওয়ার্ক, ইতিবাচক মনোভাব, ফিডব্যাক গ্রহণের মানসিকতা, স্পষ্ট মৌখিক যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা ও দ্বন্দ্ব ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার অনুদক্ষতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাছাড়া নিজের যুক্তিসঙ্গত মত প্রতিষ্ঠায় অটল থাকা বা দৃঢ় প্রত্যয়মূলক দক্ষতা, অন্যায়, অযৌক্তিক ও অনাকাংখিত চাপ প্রত্যাখান করা অর্থাৎ ‘না’ বলার দক্ষতা ও আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা।
অত্র নিবন্ধে আমি পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার প্রভাব নিয়ে গল্পের মাধ্যমে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তার আগে সম্পর্কের ধরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমার মতে সম্পর্কের পাঁচটি ধরন আছে; মিষ্টি, ঝাল, টক, তিক্ত এবং স্বাদহীন। বস্তুত স্বাদহীন সম্পর্ক আমরা কেউই চাই না। সবাই মিষ্টি সম্পর্ক চাই। কিন্তু অতি মিষ্টি মানেই তিতা। চানক্যকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বিষ কি? তিনি বলেছিলেন, ‘অতিরিক্ত যেকোন জিনিষই বিষ।’ সে মিষ্টিই হোক, আর সম্পর্কই হোক। তাই পরিমিত মিষ্টি সম্পর্কই ভাল। অনেকে টক- ঝাল- মিষ্টি সম্পর্ক পছন্দ করেন। কিন্তু এখানে তিন পদের মিশ্রণ থাকায় এ সম্পর্ক ভেজাল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পরিমিত মিষ্টি সম্পর্ক দীর্ঘদিন বয়ে বেড়ানো যায়। সম্পর্ক যখন তিক্ত হয়ে যায় তখন এটা বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। সেখানে অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা দানা বাঁধতে থাকে। আমি এখানে যে সম্পর্কের কথা বলছি সেটা হল পাতানো সম্পর্ক যেমন ; বৈবাহিক বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক অথবা সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ক নয়। এইসব সম্পর্ক কোন এক পর্যায়ে ইতি টানার প্রয়োজন হয়। তখন ঝগড়া ফাসাদ না করে গঠনমূলকভাবে সম্পর্ক ছেদ করতে পারলে সমাজ অনেক অশান্তি থেকে বেঁচে যেত। পাশ্চাত্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পরও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক থাকে। যদিও বিবাহ বিচ্ছেদ পারত পক্ষে কাম্য নয় কিন্তু আমাদের সমাজে গঠনমূলকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মামলা মোকদ্দমা ও অনেক সহিংসতা কমে যেত।একই কথা প্রযোজ্য অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।
সম্পর্কের বিপরীত শব্দ হলো দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের অবশ্যম্ভাবি ফলাফল হল রেগে যাওয়া। একটা কথা আছে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। তাই দেখা যায় রাগী লোকজন জীবনে খুব বেশি দূর এগোতে পারে না। দ্বন্দ্বমূলত শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ বা মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখা থেকে। রেগে যাওয়ার পরে মুখ দিয়ে যে কঠিন কথাগুলো আসে তার জন্য আমরা পরবর্তীতে অনুতপ্ত হই। আবার মানসিক দ্বন্দ্ব প্রায়শই চূড়ান্তভাবে প্রচন্ড ঝগড়া বা খুন খারাবিতে রূপ নেয়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে দুই পক্ষকে ছাড় দিয়ে উভয়ের জন্য সম্মানজনক মিডল পয়েন্ট বের করা যেটা হবে এক ধরনের উইন-উইনসিচুয়েশন যেখানে উভয়ের সম্মান বজায় রেখে কম্প্রমাইজ হয় অর্থাৎ যেখানে উভয় পক্ষই জেতার আনন্দ উপভোগ করবে।
পারিবারিক দ্বন্দে রেগে যাওয়ার আগে আলোচনা শুরু করা দরকার এবং একটি একমত হওয়ার কৌশল বের করা বা মিডল পয়েন্ট বের করা উচিৎ। রাগউঠলে ঐ জায়গা থেকে চলে যাওয়া এবং এ বিষয়ে পরে কথা বলা উচিৎ। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং মানসিক চাপের সময় কঠিন বিষয় আলোচনায় না আনা উত্তম। রাগ উঠতেই পারে। খুব কম মানুষ আছে যাদের রাগ নেই। পরিমিত রাগ তরকারির লবণের মত স্বাদ বাড়ায় কিন্তু অপরিমিত রাগ তরকারি বিস্বাদ করার মত সম্পর্কের বারোটা বাজায়। তবে রাগ করলেও সর্বদা ক্ষমা চাওয়া ও অনুতপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকলে রাগের কারণে সম্পর্ক নষ্ট হলেও অনেক সময় সেটা জোড়া লাগানো যায়। পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিজে নিজেই মেনেজ করতে হয়। সেখানে উকিল, মোক্তার বা অন্য কাউকে বিচারক হিসেবে ডাকলে জটিলতা বাড়তে পারে। সেক্ষত্রে শুধু নিজের ব্যাখ্যা নয়, অন্যের ব্যাখ্যাও শুনার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। দ্বন্দে দুইয়ের অধিক ব্যাক্তি জড়িত থাকলে পারিবারিক বৈঠক ডাকা উচিৎ।
পারিবারিক জীবনে সুস্থ সম্পর্ক রক্ষার জন্য যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এটা হ্তে পারে বুকসেলফ বা ফুলের টবটি কোথায় রাখা হবে সেটা থেকে শুরু করে ফ্লোরে কি ডিজাইনের টাইলস লাগাবেন সেটা পর্যন্ত। এব্যাপারে আপনার ১০ বছর বয়সী ছেলে/ মেয়েটির ও পরামর্শ শুনতে পারেন কিন্তু সিদ্ধান্ত আপনি নিবেন যুক্তি, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা এবং বাস্তবতাকে সামনে রেখে অর্থাৎ সিদ্ধান্তটি কতটা যৌক্তিক এব্যাপারে অতীত অভিজ্ঞতা কি বলে, সিদ্ধান্তটি দূরদর্শি হল কিনা এবং এটা বাস্তবায়ন যোগ্য কি না এ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপুর্ণ অনুদক্ষতা হল সক্রিয় শ্রবণ। এব্যাপারে একটি গল্প বলি।এক নবদম্পতি রাত্রে ঘুমানোর আগে গল্প করছিলেন। এক পর্যায়ে স্ত্রী বললেন, ‘হেগো, তুমিতো আমার অনেক গুণ দেখে আমাকে বিয়ে করেছ কিন্তু আমি যে খুব ভাল গায়িকা সেটা কি তুমি জানো?’ স্বামী বললেন,’ না, আমি জানি না।’ এবার স্ত্রী বললেন, ‘আজ আমি আমার বেস্ট দুইটি গান তোমাকে শুনাবো। ‘স্বামী মনোযোগের ভঙ্গি নিয়ে বললেন,’ শুনাও। ‘স্ত্রী যখন গান দুটি গাওয়া শেষ করলেন, তখন স্বামীর ছোট খাট এক ঘুম শেষ। এবার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার গানের গলা কেমন?’ স্বামী বললেন,’ এক কথায় চমৎকার। ‘স্ত্রীর একটু সন্দেহ হল। তিনি বললেন,’ বলতো, আমি প্রথম কোন গানটি গেয়েছিলাম? ‘স্বামী বেচারা আমতা আমতা করে বললেন,’ ইয়ে মানে, আমি গানের কলি খুব কমই মনে রাখতে পারি।‘ স্বামীর এই কপট আচরণে স্ত্রীর দুঃখের সীমা রইল না। সেদিন থেকে তার সুকুমার বৃত্তির অবনতি আর ডিপ্রেশন শুরু হল। অথচ স্বামী যদি একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতেন অথবা সততার পরিচয় দিতেন তাহলে পরবর্তী জটিলতা এড়ানো যেত।
এবার প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক কিভাবে নষ্ট হয় সেটি একটি গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা যাক। ধরুন আপনি অফিসে গিয়ে আপনার একসহকর্মীর কাছে শুনলেন আপনার অন্য এক সহকর্মী আপনার বসের কাছে আপনার সম্পর্কে বেশ কিছু আপত্তিকর ও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন এবং বসও তাতে সায় দিয়েছেন। আর যায় কোথায়, শুনেই আপনার চান্দিগরম হয়ে গেল। আপনি সাথে সাথে আপনার রুমে এসে কোন ইস্যু ছাড়াই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঐসহকর্মীকে উত্যক্ত করা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে বিষয়টি প্রচন্ড ঝগড়ায় রূপান্তরিত হল। রাগের চোটে আপনি উনাকে এক হাত নিলেন, যা তা বলে ফেললেন। পরিণামে উনার সাথে আপনার চিরদিনের জন্য সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। রাগের চোটে বস সম্পর্কেও আপনি দু-চারটা নেগেটিভ কথা বলতে ছাড়লেন না। কথাগুলো বসের কানে গেল। উনার সাথেও আপনার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। দুদিন পর শুনলেন আপনার সহকর্মী আপনাকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এ তথ্য বিশ্লেষণ বা যাচাই বাছাই না করেই আপনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন। এবার যিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন তার সাথে একচোট ঝগড়া করলেন এবং এর ফলে তার সাথেও আপনার সম্পর্ক নষ্ট হল। এভাবে তিনজনের সাথেই আপনার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। অথচ আপনি যদি একটু কৌশলী হতেন তাহলে সহকর্মীর দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করতেন এবং তারপর ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে বিষয়টি পুরো বিষয় জেনে ইতিবাচকভাবে মোকাবেলা করতে পারতেন। আর ঐ সহকর্মীকে হেসে হেসে বলতে পারতেন যে, ভাই, আমার কলিগ এবং বস আমার সম্পর্কে যা বলেছেন তা সঠিক। বরং আমার দোষ তারচেয়েও একটু বেশি আছে। এটা এমন কিছু না।
উপর্যুক্ত সকল গল্পের মূল বক্তব্যই হল আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক। সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কচর্চা খুবই জরুরি। জীবনদক্ষতার এই উপাদানটি আয়ত্ত করতে পারলে একজন মানুষ সুনাগরিক হওয়া সম্ভব। আজকের সমাজ বাস্তবতায় একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়তে হলেও জীবন দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এ দক্ষতা অর্জন করলে চলমান জীবনের বহুসমস্যা সহজে সমাধান করা যাবে।
লেখক : শিক্ষক।