চীনে শি জিনপিংয়ের কর্তৃত্ববাদী শাসন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২৩, ৭:৪৪:২৬ অপরাহ্ন

অ্যাডভোকেট আনসার খান
২০১২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শি জিনপিং নিজের একক আধিপত্যবাদী নেতৃত্ব ও শাসনে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য চীনে কয়েকদশক ধরে চলা প্রাতিষ্ঠানিক যৌথ নেতৃত্বের বিধান বাতিল করে চীনকে আবারও ‘ব্যক্তিত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক’ শাসনে নিয়ে এসেছেন এবং চীনা বিপ্লবের জনক মাও সে তুং এর পরে শি-ই এখন চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী একক কর্তৃত্ববাদী নেতা ও শাসক।
যুক্তরাষ্ট্রের গুইলফোর্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জুয়েঝি গুউ মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে ‘দলের নেতৃত্বে এখন আর কোনোও বিরোধিতা নেই, এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সও নেই।’ অর্থাৎ শি জিনপিং এখন চীনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সর্বেসর্বা নেতা ও শাসক হয়ে উঠেছেন। মার্কিন বিলিয়নিয়ার রে ডালিও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের শাসনাধীন চীনা শাসনকে মার্কসবাদী ও পুঁজিবাদী প্রভাবের সাথে মিশ্রিত ‘স্বৈরাচারী শাসন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শি’র অধীনে ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রীকরণ’ ঘটেছে চীনে। এটি পূর্ববর্তী শাসনগুলোর চেয়েও অধিকতর মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে, ইউ.এস. সান ডিয়েগো টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরী চায়না সেন্টারের পরিচালক সুসান শির্ক চীনের বর্তমান শি নেতৃত্বে পরিচালিত চীনা শাসনকে ‘শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিগত একনায়কতান্ত্রিক শাসন’ বলে বর্ণনা করেছেন। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না পলিসি প্রোগ্রামের প্রফেসর ও পরিচালক ডেভিড শ্যামবাঘ শি জিনপিংয়ের শাসনকে,- ‘নব্য সর্বগ্রাসী‘ শাসন বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, শি শাসনে ‘অত্যধিক সুশৃঙ্খলা, সামরিক সদৃশ শ্রেণীবিন্যাস, গোঁড়া মতাদর্শের প্রত্যাবর্তন এবং ব্যক্তিত্ববাদের (পারসোনালিটি কাল্ট) পুনরুত্থান’ ঘটেছে।
সামগ্রিকভাবে শি’র অধীনে চীনা শাসন সম্পর্কে শ্যামবাঘের মন্তব্য হলো, ‘এটি একটি অত্যন্ত অনিরাপদ শাসন, ভীতিকর সমাজ, এমনকি প্যারানয়েড‘ যা সুশীল সমাজের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে শাসনের সমালোচনার জায়গা সংকীর্ণ করেছে এবং এইভাবে একটি নজরদারি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে চীনে। ‘চীনের অভ্যন্তরে, শি’র শাসনে রাজনৈতিক বিতর্কের সীমাবদ্ধতার কারণে একমাত্র রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার ভেতরে বিকল্প মতপ্রকাশের অধিকার ও সূযোগ বারিত করা হয়েছে এবং দলীয় ফোরাম ও এর বাইরে মূলত শি জিনপিংয়ের আদর্শগত অগ্রাধিকারকে মনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেয়ারব্যাঙ্ক সেন্টার হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল রাজওয়ালী ফাউন্ডেশন ইন্সটিটিউট ফর এশিয়া, কেমব্রিজে একটি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিলো, এবং ওই সিম্পোজিয়ামের আলোচকরা একমত হয়েছিলেন যে, শি জিনপিংয়ের স্বৈরাচারী ও আদর্শিকভাবে পরিচালিত শাসনশৈলী কার্যকরভাবে বিকল্প কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করেছে এবং দেশের অভ্যন্তরে দমন-পীড়ন বৃদ্ধি করেছে। শি তিনদশক ধরে চলা যৌথ নেতৃত্ব নীতি ত্যাগ করে নিজের একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব স্হাপন করেছেন দলে ও সরকারে। ২০১২ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই শি তার ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও কেন্দ্রীভূতকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন এবং তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে তিনি আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছেন।
২০১২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে শি জিনপিং চীনের রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর নিজের ‘সর্বগ্রাসী’ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খার বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক দমন-পীড়নের মাধ্যমে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিহত করে দলে ও সরকারে একক কর্তৃত্ব স্হাপন করেছেন। চীনা সিস্টেমের মধ্যে কঠোর শক্তির কাঠামোগুলোর ওপর শি তার একক নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য সুরক্ষিত করে নিয়েছেন। যেমন, পিপলস লিবারেশন আর্মি, গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা মন্ত্রক, কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ও আইন বিষয়ক কমিশন, যা সমস্ত আইনী ও নিরাপত্তা প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান করে, এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান,- সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশন, যেটি পার্টি ডিসিপ্লিন তথা দলীয় নেতৃবৃন্দের দূর্নীতিগ্রস্থ কার্যকলাপ লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করে -তার সবগুলোর ওপর শি’র শক্তিশালী কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, পার্টি ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে শি’র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করার জন্য একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
শির্ক মন্তব্য করেছেন যে ‘শি জিনপিং অধস্তনদের উপর প্রচন্ড টপ-ডাউন চাপ সৃষ্টি করে কোনো না কোনোভাবে তাদের আনুগত্য আদায় করেছিলেন।‘ দূর্নীতি বিরোধী অভিযানের তথা শুদ্ধি অভিযানের সময় পার্টির প্রায় পাঁচ মিলিয়ন কর্মকর্তা এফেক্টেড হয়েছিলেন, যারা শি বিরোধী বলে মনে করা হয়। নামে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন হলেও চীনকে, একদলীয় কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে শি জিনপিংয়ের চুড়ান্ত কর্তৃত্বে পরিচালিত একটি ‘ আগ্রাসী ও সর্বগ্রাসী‘ শাসন হিসেবে বর্ণনা করেছেন রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষকরা। ‘সর্বগ্রাসী‘ শব্দটি ‘স্বৈরাচারী‘ থেকে আলাদা মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ‘সর্বগ্রাসী আকাঙ্খা‘ সমস্ত জনগণের দেহ ও মনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করাকে বোঝায়। ‘সর্বগ্রাসবাদ‘ শব্দটি ১৯২৬ সালে রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক লুইজি স্টুরজো কর্তৃক প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিলো ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনকে সংঙায়িত করার জন্য। ‘রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রীকরণ, কর্মের সমস্ত স্বাধীনতাকে দমন করে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নির্বাহী ও প্রশাসনিক, উভয়ই একক আধিপত্যবাদী ক্ষমতায় রূপান্তরিত করে এবং এর ফলে এটিকে প্রকৃত স্বৈরাচারী ও সর্বগ্রাসী ক্ষমতায় রূপান্তরিত করে।’
সর্বগ্রাসীবাদ একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে সমাজের প্রতিটি দিকে অনুপ্রবেশ করে এবং সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সর্বগ্রাসী শাসনে ব্যক্তি ও সমাজ, উভয়ই সহ অন্যান্য সবকিছুর উর্ধ্বে রাষ্ট্রকে উন্নীত করে। সর্বগ্রাসী শাসক তাদের শাসন পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে দমন-পীড়ন ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকা-ের ওপর ভিত্তি করে জনগণের মধ্যে নিছক ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে। অর্থাৎ জনমনে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা হলো সর্বগ্রাসী শাসকের শাসন পরিচালনার মৌলিক ভিত্তি।
শি জিনপিংয়ের শাসনামলে চীনকে প্রযুক্তিগতভাবে একধরনের সর্বগ্রাসীবাদী শাসনে ফিরে আসা হিসেবেও বর্ণনা করা যেতে পারে। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পরে নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের শাসক হয়েছিলেন মাও সে তুং এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মাও পর্যায়ক্রমে সর্বগ্রাসী মডেলের রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন চীনে। তবে ১৯৭৬ সালে মাও সে তুং এর মৃত্যু পরবর্তী শাসক দেং জিয়াওপিং এবং হু জিনতাও সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৮৭ থেকে ২০১২ সালে শি’র উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত, ১৯৪৯ সালের চীনা বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো চীনা জনগণকে কিছুটা হলেও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিলো, যেমন-ক্রয়-বিক্রয়ের অধিকার, ঘুরে বেড়ানো, বিদেশ ভ্রমণ করার অধিকার সহ জনগণের মতামতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিলো। শাসক হিসেবে শি’র উত্থানের পূর্ববর্তী প্রায় তিন দশক চীনে যৌথ নেতৃত্বে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়েছিলো।
মাও সে তুং এর মৃত্যু পরবর্তীতে দেং জিয়াওপিং এবং হু জিনতাও প্রায় তিনদশক সময়কালে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের ওপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেন এবং একক আধিপত্যবাদী নেতৃত্বের বিপরীতে সামষ্টিক বা যৌথ নেতৃত্ব প্রবর্তন করেন, নেতৃত্বের বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ, শীর্ষ নেতৃত্বের ৫+৫, দুই মেয়াদ দশ বছর সীমিত করা সহ নানাবিধ উদারনীতি গ্রহণ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার স্হলে গণতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শাসন প্রবর্তন করেছিলেন। ওই সময় ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। পার্টি থেকে সরকারি সংস্থাগুলোকে কর্তৃত্ব অর্পণ করা ও পার্টি প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত সভার আয়োজন করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এইসকল পদক্ষেপগুলো কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক জীবনকে নিয়মিতকরণ এবং স্বৈরাচারী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য করেছিলেন, যাতে যৌথ নেতৃত্ব কার্যকর হয়ে ওঠে এবং সরকার ও দলে বিভাজন টানা সম্ভব হয়। স্বৈরাচার প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত করার জন্য শান্তিপূর্ণ নেতৃত্বের উত্তরাধিকার নীতি অনুশীলন করারও উদ্যাগে গ্রহণ করা হয় তখন। অর্থাৎ শাসনের নিয়মিতকরণ, নেতৃত্ব নির্বাচনে শৃঙ্খলা প্রবর্তন করা এবং পার্টি ও সরকারকে পৃথক করে একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করা হয়েছিলো, এবং দেও জিয়াংপিং এবং হু জিনতাও একটি সম্মিলিত নেতৃত্বের উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছিলেন, যেখানে কোনো একক ব্যক্তির স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা প্রয়োগের সূযোগ ছিলো না। এই ব্যবস্হা তিনদশক ধরে চলে আসছিলো। তবে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্ব নিশ্চিত হওয়ার পরে তিনি যৌথ নেতৃত্বের ধারা থেকে সরে আসতে থাকেন।
শি জিনপিং পার্টি ও সরকারের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকে আবারও সর্বগ্রাসী শাসনের দিকে পরিচালিত হয়েছেন। পার্টিকে চীনা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূণ:প্রবেশ করা হয়েছে। পার্টির মতাদর্শে শি’র ব্যক্তিগত অবদান, ‘নতুনযুগের চীনা বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের উপর সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা, ‘শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারা’ মোড়কে পার্টির সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে চীনা রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর শি’র একক কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট ও নিশ্চিত করা হয়,- যা চীনের শাসনব্যবস্হায় শি জিনপিংয়ের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অনুমোদনের দ্বারা কার্যকর করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেং জিয়াওপিং এবং হু জিন তাও শাসনের তিন দশক পরে শি জিনপিংয়ের কর্তৃত্ববাদী শাসনে চীনে আবারও ভীতিকর শাসন কায়েম হয়েছে।
সূত্র : মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার প্রবন্ধ। ফক্স নিউজ, জার্নাল অব ডেমোক্র্যাসি, দ্য আমেরিকান ইন্টারেস্ট, ফরেন পলিসি, দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।