উষ্ণায়ন ও গাছপালা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুন ২০২৩, ৩:২৪:০০ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ আব্দুল হক
দেশে দেশে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে। বিরূপ আচরণ করছে না বলে বলা যায়, মানুষের অতি আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার নেশায় প্রকৃতি বিনাশী পদক্ষেপের কারনে প্রকৃতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির উপর যাচ্ছেতাই আচরণ করলে সে সইবে কেমন করে। তাই বৈশ্বিক পরিবেশ আর মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সুখের নেই। বৈশ্বিক পরিবেশের বাহিরের দুনিয়ায় আমরা নই, তাই আমরাও ভালো নেই। গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে ভয়াবহতম গরমে বাংলাদেশের জনগণের জীবন হাঁসফাঁস। এর কারণ আছে। আসুন কারণ খুঁজে দেখি এবং বাঁচার উদ্যোগ গ্রহণ করি।
পত্রিকায় আবহাওয়ার খবর খুঁজতে গেলে জানতে পাই, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন আমরা এবং আমাদের এই পৃথিবী। আমাদের দেশ তুলনামূলক ভাবে কঠিন দুর্যোগে আছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত সত্য কথা হলো, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে যে-কোনো দেশের মোট আয়তনের অন্তত পঁচিশ ভাগ থাকতে হবে বনাঞ্চল, যা আমাদের বহু বছর আগে থেকেই নাই। তারপরও আমাদের সুন্দরবনে চালানো হলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরমাণু বিদ্যুৎ আবিস্কারের কর্মযজ্ঞ। বহু বছর ধরে পত্রপত্রিকা লিখে চলেছে আমাদের দেশের বনাঞ্চল তুলনামূলক ভাবে অনেক অনেক কম। এখন দিনে দিনে তা-যে আরও কমে গেছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। শহরের ছোটো বড়ো পুকুর ভরাট হতে হতে একেবারে নিঃস্ব হওয়ার পর্যায়ে। হ্যাঁ, এ-সব প্রবনতাই আমাদের পরিবেশ উষ্ণ হওয়া ও জনজীবনে হাঁসফাঁস চলার অন্যতম কারণ। শুধু মানুষের জীবন নয় পশু পাখি কেউ ভালো নেই। আমাদের সঙ্গী পাখি গরমে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে উষ্ণতা সইতে না-পেরে উড়ে উড়ে বারান্দায় আসে। আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে সামনের ও পিছনের বারান্দায় দুটি মাটির দইয়ের পাতিলে পানি পূর্ণ করে রেখে দিয়েছি এবং পাশে ছড়িয়ে দিই চালের গুঁড়া, বিস্কুট। পাখিরা আসে। আমি শান্তি পাই।
আমাদের পড়া হলো জানা হলো কিন্তু শিক্ষা নেয়া হলো না। নিকট অতীত কালে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষক এবং বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন বৈশ্বিক উষ্ণতার মূল কারণ হলো বায়ু মন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো, কিভাবে এবং কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে? এর ফলে পৃথিবীর মানুষের কি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে? ইতিহাস থেকে আমাদের জানা আছে গোটা ইউরোপে অর্থাৎ জার্মান, বৃটেন এমনকি রাশিয়ায় আঠারো-শো শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে দুনিয়া জুড়ে উন্নয়ন এবং পরিবর্তনের ছোঁয়ায় পর্যায়ক্রমে মানুষের জীবনাচারে ব্যাপকভাবে এবং দ্রুত গতিতে পরিবর্তন এসেছে। তখন থেকে একে একে পৃথিবীর নানা দেশে কল কারখানায়, রেল ইঞ্জিন সহ নানান রকম যানবাহনে কয়লা, গ্যাস, ডিজেল ইত্যাদি পোড়ানো শুরু হয় শক্তি প্রাপ্তির জন্যে। আর এসব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন হয় কার্বন ডাই অক্সাইড। এই যে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড তা আমাদের পরিবেশের উদ্ভিদের মাধ্যমে শোষিত হতে পারছে না। কারণ, তুলনায় বনাঞ্চল কম। উপরন্তু পৃথিবীতে মানুষ বৃদ্ধির হার দিনে দিনে বাড়তে থাকায় তাদের বিভিন্ন চাহিদা মিটাতে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ-পালা, ছোট ও মাঝারি বন, এমনকি বড়ো বড়ো বনাঞ্চলও মানুষের আগ্রাসী থাবায় ধ্বংস হচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেও মানুষ বিনাশ ঘটাচ্ছে উদ্ভিদ কূল ও প্রাণী কূলের। এতে বিপন্ন হচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ। আমরা যেনো ভুলেই গেছি আমাদের স্বাভাবিক ও সুস্হ জীবন যাপনের জন্যে বায়ু মন্ডলে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। বৃক্ষ নিধন চলছে আর অক্সিজেনের স্বাভাবিকতা হারাচ্ছে। এ ভারসাম্য সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পৃথিবীর জন্যে খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ ভারসাম্য বজায় থাকছে না। এ ভয়ংকর সত্যটি উপলব্ধি করতে পৃথিবীর মানুষের অনেক সময় লেগেছে। তবুও মানুষ যেনো নেশাগ্রস্ত বেহুঁশ। তা-না-হলে এখনও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনাশ থামছে না কেন?
জানা কথা আবারও সবার জানা দরকার। বায়ু মন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির ফলে আমাদের এই পৃথিবী নামক আবাসের উষ্ণতা বেড়ে গেছে। সত্য কথা হলো, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আমাদের পানি চক্রেও স্বাভাবিকতা বজায় থাকে না। অথচ এই পানি চক্র আমাদের পরিবেশের জন্যে অত্যন্ত জরুরী। এই পানি চক্রের কারণে-ই-তো জলীয় বাষ্প থেকে মেঘ হয়, আর ঐ হালকা মেঘ উড়ে গিয়ে উঁচু পর্বতের চুড়ায় পৌঁছে ঠান্ডায় জমে গিয়ে বরফে পরিণত হয়। আবার গরম কালে সূর্যের তাপে বরফ গলে গলে পাহাড়-পর্বতের গা বেয়ে পানি হয়ে নেমে আসে আমাদের পাহাড়ী ছোট ছোট নদী বেয়ে। অতঃপর সেই পানি মিশে যায় বড়ো বড়ো নদীতে। তারপর সমুদ্রে পতিত হয় প্রবাহমান জলের স্রোত। এ চক্রের স্বাভাবিকতা নষ্ট হলে সমতল ভূমি তলিয়ে যাবে সমুদ্রগর্ভে। ইতিমধ্যে এর প্রভাব পরতে শুরু করেছে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে। এতেকরে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাই বাঁচতে হলে ভাবতে হবে। অবহেলায় আরও সময় গেলে উদ্ভিদ জগৎ কিংবা প্রাণী জগতের কেউ বাঁচবে না।
বাংলাদেশে এখন অতি উষ্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় রয়েছে। আসুন আমাদের এতদোঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করি। ঐতিহাসিক ভাবে সত্য আমাদের এই বাংলাদেশ একটা সময় ছিলো জীব বৈচিত্র্যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের অনেক প্রাণী এবং উদ্ভিদ হয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তির পথে। বিভিন্ন তথ্যে জানা যায় বিগত চার দশকেরও বেশী সময়ে আমাদের মাছের সংখ্যা কমে গেছে ব্যাপকভাবে। তাই এসব রক্ষায় এখনই কার্যকর ব্যবস্হা না-নিলে আগামী দুই তিন দশকে আরও অনেক প্রজাতি বিলীন হয়ে যেতে পারে। শুধু মৎস্যকূল নয় নানা রকম উপকারী পোকা-মাকড় এবং পাখিকূলও বিপন্ন হয়ে যাবে। গরমে ও পরিবেশ দূষণের কারণে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। রীতিমতো একটা আঁতকে উঠার মতো খবর হলো, আমাদের সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে গেছে। আমাদের সুন্দরবন এবং বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে পরিবেশবিদদের মাঝে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা এবং লেখালেখি হচ্ছে দীর্ঘ দিন যাবৎ। জীব বৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনে পরিবেশবাদী সমাজ সচেতন মানুষের মানব বন্ধন, পথসভা, লংমার্চ ইত্যাদিতে দেশের সাধারণ মানুষও এখন ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছে। আমাদের বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথচ সরকার সেই সুন্দরবন ঘেঁষে নতুন করে শিল্প বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করলেন। আমাদের সীমিত সম্পদ, সীমিত বনাঞ্চল। তাই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে এতে পরিবেশের বিরাট ক্ষতি হলো। তাই দেশের স্বার্থে এবং এক
বিশ্বের স্বার্থে বিজ্ঞ এবং অভিজ্ঞজনদের নিয়ে আবারও পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এটা পরিবেশের ব্যাপার। প্রিয় পাঠক চিন্তা করেন আমাদের সুন্দরবনে এখন গন্ডার নেই , গোলাপী মাথার উড-ডাক পাখি নেই। এছাড়াও ক্রমাগত মানুষ কর্তৃক বন উজার হওয়ার কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। এতে করে প্রাণীকূলের বিভিন্ন প্রজাতি হারাচ্ছে তাদের চির পরিচিত আবাস। আর এভাবে বন উজার করার পরিণতিতে বাতাসে আরও বাড়বে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ। তাহলে আমাদের সন্তানেরা কিভাবে সুস্থ জীবন যাপন করবে?
ভয়াবহ উষ্ণতা থেকে বাঁচতে আমাদের অবশিষ্ট বন জঙ্গল রক্ষার পাশাপাশি নতুন করে বৃক্ষরোপন করে এবং নতুন ও নিরাপদ বনাঞ্চল তৈরীতে আঞ্চলিক সংস্থা সহ জাতিসংঘের এখন-ই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কাল ক্ষেপণ করার সুযোগ একেবারেই নেই। মানুষের মঙ্গলের জন্যেই জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। সবারই জানা আছে কোনো একটি ভৌগোলিক অবস্থানে উদ্ভিদ, প্রাণী, ছত্রাক ও অনুজীব মিলিয়ে গড়ে উঠে জীব বৈচিত্র্যের সমাহার। আর এটি-ই হচ্ছে প্রতিবেশ। আর যেকোনো প্রতিবেশেই প্রত্যেকেই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই কোনো একটির বিলুপ্তিতে অন্যটির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে স্বাভাবিক ভাবেই। সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হবে উন্নত মস্তিষ্কের মানুষের। তাই সকল দিক বিবেচনায় নিয়ে আমাদের স্বার্থেই জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের বাঁচার জন্যে বায়ু মন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকাতে এবং পরিবেশ বাঁচাতে এখনই সচেতন হতে হবে।।
লেখক : কলামিস্ট।