আফতাব চৌধুরী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জুন ২০২৩, ১:৫৬:৩৭ অপরাহ্ন
ব্যক্তিত্বের বিকাশই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত
শিক্ষাক্ষেত্র থেকে নৈতিক শিক্ষার অপসারণ বর্তমান সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং যুব সম্প্রদায়ের উপরে তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াও লক্ষণীয়। তারা প্রচলিত মূল্যবোধকে অবহেলা করে সংগঠনের প্রতি বিক্ষোভ দেখায়। এর ফলে যুবসমাজ বেপরোয়া হয়ে উঠে এবং মাদক, ড্রাগ ইত্যাদি সর্বনাশা নেশায় আসক্ত হয়। এক সময় হিপি আন্দোলন ছিল যুব মানসের অন্তরে অসন্তোষ এবং অর্থহীনতার এক বাহ্য বিকশিত রূপ। নৈতিক শিক্ষা ব্যতীত যুব সম্প্রদায় হালবিহীন হয়ে পড়ে । এদিকে মদ্যপান ও ড্রাগের প্রতি আসক্তি যুবসমাজকে আতঙ্কবাদ, খুন, সন্ত্রাসসহ সমাজবিরোধী অনেক কাজে প্ররোচিত করে। আধুনিক সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটাই হতাশাব্যঞ্জক যে, নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য আইনানুগ নীতি এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যও নিতে হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। রাশিয়া ও চীনে ধর্মকে বাদ দিয়েই ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার অনেক প্রচেষ্টা হয়েছিল কিন্তু বাস্তবে সেগুলো সফল হয়নি। বিশ্বের ধর্মগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সকল ধর্মই সত্য, প্রেম, অহিংসা, বিনয় ইত্যাদি কিছু নৈতিক বিষয়ে একমত পোষণ করে। নৈতিকতার এ উপাদানগুলোÑযা সব ধর্মেরই অর্ন্তভুক্তÑঅবশ্যই শিক্ষার অঙ্গ হিসাবে গণ্য করতে হবে, তা সে প্রথাসম্মত বা প্রথাবহির্ভূতÑযাই হোক।
সাধারণভাবে শিক্ষা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা হল শিক্ষালয়ে যাওয়া, বই পড়া এবং পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা তা নয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশই হল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু গুণ আছে, যা শৈশবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শিক্ষা এক বিশেষ পন্থা, যার সাহায্যে মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত শক্তি বিকশিত হয় ও ফলসরূপ তার বিকাশ পূর্ণতা লাভ করে। মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য শারীরিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ প্রয়োজনীয় হলেও এক্ষেত্রে তার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
শিক্ষার অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য চরিত্র গঠন ও নৈতিক জীবন যাপনে মানুষকে সাহায্য করা, যার ফলে তার নৈতিক বিকাশ ঘটে। কিন্তু এ বিশেষ ক্ষেত্রে অধিকাংশ আধুনিক শিক্ষা প্রণালী ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার কারণ স্পষ্ট। বর্তমান যুগের আগে পর্যন্ত নৈতিকতা ধর্মেরই তত্ত্বাবধানে ছিল এবং সর্বত্র তা শিক্ষাও ধর্মের মাধ্যমে দেওয়া হত। বিদ্যালয় পাঠক্রম থেকে ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতাও বহির্ভূত হল। এর কারণ হচ্ছেÑধর্মের যেমন কিছু অত্যাবশ্যক, সার্বজনীন ও শাশ্বত উপাদান আছে তেমনি সংস্কার, সমাজিক প্রথা, পুরাণ, মতবাদ ইত্যাদি কিছু সীমিত, পার্থিব উপাদানও ধর্মের আয়ত্তাধীন। এ ধরণের অনেক অনাবশ্যক উপাদানের সঙ্গে বিজ্ঞান এবং আধুনিক সামাজিক চিন্তা ধারার সংঘাত লক্ষ্য করা যায়। বাস্তবে ধর্মীয় বিবাদ, সন্ত্রাস, দাঙ্গা ইত্যাদি মূলত এ ধরণের অনাবশ্যক উপাদান থেকেই উদ্ভূত হয়। তাই ধর্মের এই উপাদানগুলোকেই প্রকৃত ধর্ম ভেবে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে তাকে বহির্ভূত করা হয়েছে। র্দুভাগ্যের বিষয়, এ পদ্ধতিকে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনের চিরন্তন সত্য অপসৃত হয়েছে। নৈতিক তত্ত্বের নিছক শিক্ষা দেওয়াই কিন্তু যথেষ্ট নয়Ñকারণ যুবসমাজের কাছে এ ধরণের শিক্ষা অবাঞ্ছিত উপদেশের সমতুল্য। বস্তুত, ইচ্ছাশক্তি, বিশ্বাস এবং নিঃস্বার্থপরতা এ গুণসমূহের বিকাশের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়।
মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য নৈতিক শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক শক্তি বলতে ‘ইচ্ছাশক্তি’ বোঝায় এবং সেটা হল আত্মিক শক্তি। এ শক্তিকে অবলম্বন করেই সর্বদা নৈতিক পথে অগ্রসর হওয়া যায়। কেবলমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি যেকোনো পরিস্থিতিতেই নীতি-পরায়ন থাকতে পারেন। শুধু দুর্বল চিত্তের মানুষই প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। সকল পাপ ও অন্যায়কাজ ‘দুর্বলতা’ শব্দটির মধ্যে নিহিত আছে। দুর্বলতাই সকল অন্যায় কাজের উৎস; দুর্বলতাই অপরকে আঘাত দিতে মানুষকে প্ররোচিত করে, দুর্বলতাই তাদের প্রকৃত রূপ থেকে ভিন্ন রূপে বিকশিত করে।
আত্মিক শক্তি কীভাবে অর্জন করা যায়, সে বিষয়ে মনে একটি প্রশ্ন জাগে। সমাধানÑবিশ্বাসের মাধ্যমে। এখানে বিশ্বাস বলতে নিজের উপর বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে, নিজের উপর বলতে আত্মাকে বুঝানো হয়েছেÑঅহঙ্কারকে নয়। আত্মা চির-পবিত্র, চির মুক্ত ও অমর এবং আমাদের অন্তরতর সকল শক্তির উৎস। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়Ñ নিজেকে শিখাও, প্রত্যেককে তার প্রকৃত সত্তা সম্বন্ধে শিখাও, নিদ্রিত আত্মাকে আহ্বান কর এবং কীভাবে জেগে উঠে, দেখ। যখন নিদ্রিত আত্মা জেগে উঠে আত্মসচেতন করে দেয়- তখন শক্তি, সম্মান, সাধুতা লাভ হয়, পবিত্রতা এবং যা কিছু উত্তম তা অর্জন করা যায়।
নিজের উপর বিশ্বাস রাখার কথা বলা হয়েছে- একথা সত্য কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখতে বলা হয়নি। কারণ, নিজের উপর বিশ্বাস এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস প্রায় সমার্থক। আল্লাহ আমাদের অন্তরেই বিরাজ করেন। তিনি পরমাত্মা। নিজের প্রকৃত সত্তা বা আত্মার উপর বিশ্বাস পোষণ করা সৃষ্টিকর্তাকে মসজিদ, মন্দির বা গীর্জায় পরমাত্মার ওপর বিশ্বাসী হওয়াকেই বোঝায়। বিভিন্ন নীতি গ্রন্থে নিঃস্বার্থপরতার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে নিঃস্বার্থপরতাই নৈতিকতার একমাত্র পরীক্ষা নৈতিকতার একমাত্র সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে : স্বার্থপর হলেই তা অনৈতিক এবং নিঃস্বার্থপর অর্থেই নৈতিক। নিঃস্বার্থপরতা আমাদের কর্ম পদ্ধতির মাধ্যমে দেখাতে হবে। শৈশব থেকেই এ গুণকে উদ্দীপ্ত করা সম্ভব। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের শিখানো উচিত যে, স্বার্থপর কর্মের তুলনায় নিঃস্বার্থ কর্ম অধিক সুখপ্রদ। দুঃস্থের সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন নিঃস্বার্থ কর্মে তাদের অংশগ্রহণ করতে যথার্থ শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। সমাজের দরিদ্র ও অনগ্রসরতার অন্যতম প্রধান কারণ তীব্র স্বার্থপরতা। দেশের হিতে অবশ্যই আত্মত্যাগ ও নিঃস্বার্থপরতা প্রয়োজনীয় বিষয়।
আধ্যাত্মিক বিকাশ বলতে নিজের মনন শক্তির বিকাশকে বোঝায়, কারণ এর সাহায্যে মানুষ তার দৈবীসত্তাকে অনুভব করে। মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্ব বিদ্যমান- লক্ষ্য হল সে দেবত্বের বিকাশ। পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিকরা সত্যকে জানার জন্য যেমন অনেক পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছেন, তেমনি আমাদের এ অঞ্চলেও হিন্দু ঋষিরা সত্যকে জানার জন্য বিভিন্ন পন্থা উন্মোচন করেছেন। এ পন্থাগুলো যোগ নামে পরিচিত।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ্য যে, আত্মিক সত্তাই মানুষের মৌলিক প্রকৃতি এবং সেটা অনুভব করতে সক্ষম না হলে দীর্ঘস্থায়ী সুখ অথবা শান্তি কখনো লাভ করা যায় না। এ জ্ঞান অর্জনের জন্যই বুদ্ধ তাঁর রাজত্ব ত্যাগ করে ভিক্ষাজীবী সন্নাসী হয়েছিলেন। সকল মানুষের মধ্যেই পরম সত্য বা জানার আগ্রহ থাকে এবং তারই তাগিদ মানুষকে পৌছে দেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের পরে পরিশেষে মানুষ সকল সুখ ও শান্তির উৎস হিসাবে আত্মিক সত্তাকে তার মনের মধ্যেই আবিস্কার করে। এখানেই আধ্যাত্মিক বিকাশের সূচনা।
সকল ধর্মের পরম লক্ষ্য হল আধ্যাত্মিক বিকাশ, সর্বোচ্চ শান্তি ও পূর্ণতা। মহামানবেরা সব ধর্মের বাস্তব অনুশীলন করে সর্ব প্রথম এ মহান সত্য উন্মোচিত করেন। তাঁরা দেখালেন যে, ধর্মের পারস্পরিক বিবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মের অনাবশ্যক উপাদানগুলোকে কেন্দ্র করে। এ সত্যের অনুধাবন এবং সকল ধর্মের শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে পরিগণিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের সব ধর্মের প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব রাখা এবং সব ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে শান্তিতে থাকার ক্ষমতা অর্জন করা উচিত।
তাই ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের জন্য সত্যিকারের শিক্ষাদান করতে ধর্মকে শিক্ষার অঙ্গ হিসাবে গন্য করতে হবে- শিক্ষা প্রথাগত বা প্রথাবহির্ভূত নির্বিশেষে। মানুষের ব্যক্তিত্বের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের অভাবে বর্তমান বিশ্ব সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাই ধর্ম শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হলে মানবজাতির কল্যাণ ত্বরান্বিত হবে। এখন সহজেই অনুভব করা যায়, বিজ্ঞানের সুবাদে অলৌকিক উন্নতি বিধান হলেও সব সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি। আইনস্টাইন, হাইজেনবার্গ প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন। সময় এবং অবস্থান বিষয়ে বৈজ্ঞানিকদের চরম ধারনা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাহায্যে সজাগ হয়েছে। হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা নীতির মাধ্যমে লক্ষ্য করলেন যে, মানুষের জ্ঞান সীমিত। পদার্থবিদ নিলস বোর বলেছেন: অস্তিত্বের মহান নাটকে আমরা একাধারে দর্শক এবং অভিনেতা। তাই বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে পদার্থের উর্দ্ধে উচ্চতর নৈতিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে পদার্থবিদরা এখন মন এবং চেতনা নিয়ে গবেষণা করছেন। বর্তমানে অনেক বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস করেন যে, মন এবং পদার্থের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট নয়। আধুনিক ভৌতবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্বই প্রাচ্য ধর্মের অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেÑএকথা যেমন সত্য, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তা অনুরূপভাবে প্রযোজ্য। পাশ্চাত্যের মানোবিজ্ঞানের নিরিখে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ফ্রয়েড এবং অন্যান্য প্রাচীন মনোবিজ্ঞানীদের পিছনে ফেলে এ ক্ষেত্রেও তার অগ্রগতি অব্যাহতÑসৃষ্টি হয়েছে ‘ট্রান্সপার্সোনাল মনোবিজ্ঞান।’ বর্তমান যুগের মনোবিজ্ঞানীরা চেতনার পরিবর্তিত অবস্থার,পরম অভিজ্ঞতার কথা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেনÑযা সবই কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতারই ভিন্ন নাম।
বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, মানব সম্পদের প্রকৃত উন্নতি করা বিজ্ঞানের একক প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়নি। পক্ষান্তরে ধর্মবিযুক্তভাবে শুধু বিজ্ঞানের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করার জন্য মানবিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানব সম্পদের প্রকৃত বিকাশের জন্য ধর্ম এবং বিজ্ঞানের পরিপূরক ভূমিকার প্রয়োজন। সুতরাং অনতিবিলম্বে ধর্মকে পুনরায় শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করাই এ অভিমুখে প্রথম পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারে।
লেখক : কলামিস্ট, সাংবাদিক।