পারিবারিক শিক্ষা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুন ২০২৩, ৪:২৯:৫৬ অপরাহ্ন

রোমেনা আফরোজ
একটা সমাজের সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে তার পরিবার। এখান থেকেই শিশুর মানসিক বিকাশ গড়ে উঠে। যদিও বর্তমানে পারিবারিক শিক্ষাকে অবমূল্যায়িত করে এর দায়ভার চাপানো হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর, কিন্তু এই অর্পণ অদূরদর্শিতা ছাড়া কিছু নয়। মূলত মূল্যবোধ, নৈতিকতা, শ্রদ্ধা-স্নেহ, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি বিষয়গুলো শেখানো হয় পরিবার থেকে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সমষ্টিগত অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে ভেঙে দিয়ে একটা কৌশলগত দূরত্ব তৈরি করেছে। এ কারণে রাষ্ট্রের জন্য যা কিছু কল্যাণকর, তা পরিবার এবং সমাজের জন্য নাও হতে পারে। এই যে পারিবারিক সংস্কৃতিতে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদকে তার নিজস্ব পথ তৈরি করার জন্য পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে দাঁড় করাতে হয়েছে কাঠগড়ায়। তবেই বিজাতীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ সম্ভব হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শেষ কথা নয়, বরং এই দুই ক্ষেত্রের শিক্ষার সমন্বয়ে একটা শিশুর মানুষ হওয়া নির্ভর করে।
আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি-নৈতিকতার পাঠ নেই। মানুষ দিনদিন ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রযুক্তির প্রায়োগিক কৌশলের ব্যর্থতার কারণে বিশাল দূরত্ব রচিত হয়েছে প্রকৃতির সাথে। শিশুদের খেলনা হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। ফলশ্রুতিতে তারা একসময় প্রবেশ করছে গেমসের জগতে, আসক্ত হয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। কিশোরদের অপরাধ এখন ছোটখাট গ-ির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাদের মধ্যে অনৈতিক কাজের প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। এসব উপসর্গ দেখে বুদ্ধিজীবীদের সতর্ক হবার কথা ছিল। সাধারণকে সতর্ক করার দায়িত্বও তাদের। কিন্তু তারা যেন দায় এড়িয়ে যেতে পারলে বেঁচে যান।
বায়োলজিস্ট ব্রস লিপটন বলেছেন, একটা শিশুর সাত বছর বয়সের মধ্যে তার সারাজীবনের প্রোগ্রাম মানে আচার-আচরণ, চিন্তাধারা ইত্যাদি নির্ধারিত হয়ে যায়। অনেক অভিভাবকের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, তারা ভাবেন, তারা যা খুশি তা’ই করবেন, কিন্তু সন্তান হবে কল্পনার মত সভ্য, যেটা একেবারেই অসম্ভব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা-বাবা যেমন হয়, সন্তানও তেমনি হয়ে থাকে। আসলে শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা দেখে দেখে শেখে। তাই এইসময় পরিবারের সদস্যদের সতর্ক থাকতে হবে। যে-আচরণ আমরা সন্তানের মধ্যে দেখতে চাই না, সেগুলি প্রথমে নিজেদের বর্জন করতে হবে।
একটা শিশুকে মানুষ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ পরিবারের শিশুই একসময় সমাজের হাল ধরে। পূর্বে আমাদের যৌথ পরিবারব্যবস্থা ছিল। পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমাদের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া বদলে গেছে। অনেকে ক্যারিয়ারকে প্রধান্য দিয়ে একটিমাত্র সন্তান নিয়ে থাকেন। তাই নিউক্লিয়ার পরিবারে সন্তান লালন-পালন করার জন্য বেছে নিতে হয় আয়া, নয়তো ডে-কেয়ার সেন্টার। আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য বুঝতে পারিনি, যৌথ পরিবারে সন্তান মানুষ করা অনেক সহজ। এতে শিশুর মধ্যে দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ গড়ে উঠে; নিরাপত্তাহীনতা প্রবেশ করতে পারে না। পারিবারিক আবহাওয়া যদি নেতিবাচক হয় তবে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সেক্ষেত্রে তাদের নেতিবাচক মানসিকতা পরিবার থেকে সমাজদেহে প্রতিফলিত হয়। মূলত পরিবার থেকেই ভালো-মন্দের ডালপালা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। একটা বিল্ডিং কতটুকু মজবুত হবে তা যেমন নির্ভর করে ভিত্তিপ্রস্তরের উপর, তেমনি পারিবারিক শিক্ষার উপর নির্ভর করে শিশু এবং সমাজের ভবিষ্যত।
অনেক বাবা অফিস থেকে ফিরে কাজের অজুহাতে নিজের মত সময় কাটান; সন্তানকে সময় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। কিন্তু এই বয়সে সন্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারলে পরবর্তীতে ওরা বিভিন্ন ঘটনার যোগ-বিয়োগ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। সেসব সিদ্ধান্ত সবসময় ইতিবাচক নাও হতে পারে। সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা সমান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কেননা দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার শিক্ষা শিশুরা ছোটবেলাতেই পেয়ে থাকে।
অনেক মা-বাবা সন্তানের পড়ালেখার অজুহাত দিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে যান, যা একবারেই অনুচিত। চারপাশের মানুষজনের সাথে শিশুদের মেলামেশার প্রয়োজন আছে। এতে ওরা পরিবার এবং সমাজের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।
শিশু যদি যথাযথ পারিবারিক শিক্ষা এবং ভালোবাসা পায়, তবে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবার পূর্বে একবার হলেও তারা পরিবারের কথা ভাবতে বাধ্য হবে। কিন্তু আমরা কি তাদের যথাযথ ভালোবাসা দিতে পারছি? পুঁজিবাদী যুগে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা যেন ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে। দামি খেলনা, মোবাইল ফোন কিংবা নানারকম বায়না পূরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে ভালোবাসার বিস্তৃতি। চাহিদা পূরণের মধ্য দিয়ে ভালোবাসা যাচাই-বাছাই হওয়ার সুযোগ নেই। এতে বয়সের সাথে সাথে শিশুর চাহিদা বাড়তে থাকে। একসময় মা-বাবা সন্তানের কাছে জিম্মিও হয়ে পড়েন। অথচ একটু মায়া, মমতা দিয়ে অনেককিছুর সমাধান করা যায়। সেক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে ধৈর্য এবং সহনশীলতা বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়।
বর্তমানে শিশুর বয়স তিন কি চার হলে তার পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় স্কুলব্যাগ। সেই ব্যাগ আলগাতে তারা হিমশিম খায়। তবুও যেন মুক্তি নেই। দিন যতই গড়াতে থাকে ততই বাড়তে থাকে ব্যাগের ওজন। মানুষ হওয়ার সাথে ওজনের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এতে শিশুর শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বর্তমানে একটা ট্রেন্ড চলছে। প্লে, নার্সারি, স্কুল, এমনকি কলেজেও একা চলতে দেওয়া হয় না বাচ্চাদের। তাদের সাথে মা-বাবা ছায়ার মত লেগে থাকেন। এতে বাচ্চাদের নিজস্ব জগত গড়ে উঠতে পারে না; নির্ভরশীলতা বাড়ে। অনেক অভিভাবক আবার ক্যারিয়ার নিয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন। এভাবে তারা যা হতে পারেননি সেই বোঝা অবচেতনভাবে সন্তানের উপর শুধু চাপিয়ে দেন না, জীবনটাকে একটা বৃত্তে বন্দীও করে রাখেন। একা একা পথ চলে ভালো-মন্দ শিখতে পারলেই কেবল বোধ-বুদ্ধি এবং চিন্তাশক্তি গড়ে উঠে, যা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের ছোটবেলা ছিল স্বপ্নের মত। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী নিয়ে বেশ ভরপুর সময় কেটেছে। গ্রামে থাকতে দাদির কাছে অনেক গল্প শুনেছি। মাকে দেখেছি দুপুরের অবকাশে শুয়ে শুয়ে গল্প বই পড়তে। সেই অভ্যাস আমাদের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। তখন ঠাকুরমার ঝুলি, কমিকস, তিন গোয়েন্দা পড়ার ট্রেন্ড ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার অজুহাতে আজকাল পাঠ্য বইয়ের বাইরে তেমন বই পড়তে দেওয়া হয় না। এই শূন্যস্থান দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন। এসব প্রযুক্তি বাচ্চাদের এমন এক জগতে টেনে নিয়ে যায়, যেখান থেকে ফেরার পথ থাকে না। অনেকে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মা-বাবাকে অভিযুক্ত করেন। অনেকে শিক্ষাব্যবস্থাকেও দোষারোপ করতে ছাড়েন না। আমার মনে হয়, এজন্য কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরাও অনেকাংশে দায়ী। তারা সেকুল্যারিজমের নামে নিজস্ব সংস্কৃতির স্থলাভিষিক্ত করতে চাচ্ছেন বিদেশি সংস্কৃতি দিয়ে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যেই গৌরব নিহিত। শেষ কথা হলো, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। তাই একে-অপরকে দোষারোপ বন্ধ করে আমাদের মূল সমস্যা অনুসন্ধান করতে হবে; পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে হবে পারিবারিক মূল্যবোধ। তবেই বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষা পাবে বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে। রক্ষা পাব আমরাও।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক