কবিতার আয়না, কবির অন্তর্গত উঠোন
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ জুন ২০২৩, ৭:৩৯:০৩ অপরাহ্ন
ফকির ইলিয়াস
একটি কবিতা যখন লেখা হয়, তখন কবির ভাবনা কী থাকেÑ কিংবা কোন প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। এই কবিতা নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। অনেক মত প্রকাশ করা যেতে পারে। অনেকভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আর তা হবে কিংবা হয় একেক রকম।
কবিতাটি কীভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সমালোচক কীভাবে দেখছেনÑ তা নিয়ে কবির কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকে না। থাকে না আক্ষেপও। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন কোথায় বসে কোন প্রেক্ষাপটে কবিতাটি লেখা হয়েছিল। একটা কথা মনে রাখতে হবে, কবিকে কাটগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। যা করা যায়Ñ তা হলো গ্রহণ অথবা বর্জন। আর এতেও কবির খুব বেশি কিছু যায় আসে না। কারণ তিনি তার কাজটি করেছেন। পাঠক তার কাজ করবেন।
শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’, কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপট যখন আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তখন তিনি এটুকুই বলেছিলেন, এই কবিতাটি আমি পাঁচ বসায় লিখেছি। অর্থাৎ পাঁচবার তাঁকে লেখার টেবিলে বসতে হয়েছিল কবিতাটি নিয়ে। এরপরে ফাইনাল করেছিলেন।
কবিতাটি কেন লিখেছিলেন, কেমন তাগিদ ছিল সে সময়! জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশকে ভালবেসেই কবিতাটি লেখা। এখন সকল পঙক্তি তো আমার নিজেরও মনে নেই!
আপনি কি আপনার সব কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট মনে রেখেছেন? জানতে চাই। তিনি বলেন, তা রেখেছি। বা স্মৃতি থেকে বলতে পারবো। কিন্তু আমার লেখা সব কবিতা মনে নেই। কেউ মনে করিয়ে দিলে শুনি। একজন কবি কি তার সকল কবিতা মনে রাখতে পারেন? রাখা জরুরি?
না, পারেন না। রাখা জরুরিও নয়। কারণ এতে পঙক্তির পুনরাবৃত্তি হতে পারে! বলেন শামসুর রাহমান।
নিজের কবিতা নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট আপনি?
মোটেও সন্তুষ্ট নই। ভালো কবিতা লিখতে পারলাম কই! আক্ষেপের সুর শামসুর রাহমানের গলায়। দেখি তিনি একপলকে ইস্ট রিভারের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাদের সামনে স্টারবাকসের কফির ধোঁয়া উড়ছে। গড়াচ্ছে বিকেল।
দুই.
আমরা আজকাল দেখি, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত কোনো কবিকে এককথায়ই খারিজ করে দেন। জসিমউদ্দীন কোনো কবিই নয়! শামসুর রাহমানের কোনো কবিতাই হয়নি! এমন কথা প্রায়ই শুনি। তারা কেন এটা করেন? করার কারণ একটাই, নিজেদের দিকে দৃষ্টি ফেরানো। আমার দিকে তাকাও! মুই কী হনুরে মার্কা আজব বুলিতে মাঝেমাঝেই ছয়লাব হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। আমরা জানি প্রয়াত একজন কবি এসে তার কবিতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। শুধরে দেবার সুযোগ নেই। তারপরেও তাকে আক্রমণ করা হচ্ছে কেন? এর কারণও হচ্ছে, আমাদের চারপাশে এমন সব আলোচক-সমালোচক জন্ম নিয়েছে, যারা বাংলা সাহিত্যে আবর্জনার চেয়েও নষ্ট! আর নষ্টরা এখন দখলদারির চূড়ান্ত বাহু দেখাবার কসরত করছে। যা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য চরম দুঃসংবাদ!
একটি কবিতা আসলে কী? কেন কবিতা মানুষের মনে ভাবনার জলছবি এঁকে যায়? এর উত্তর অনেকভাবে দেয়া যায়।
কবিতাকে আত্মিক শব্দমালায় উপস্থাপনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পরিভাষায় বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। একই সাথে কবি ও কবিতার পাঠককে ব্যক্তিগত এবং সর্বজনীন স্তরে যোগাযোগ করিয়ে দেয় কবিতা। একটি কবিতা তার নিজের এবং শব্দের বাইরেও একটি বাস্তবতা নির্দেশ করতে পারে। তা হোক রাজনৈতিক, কিংবা সামাজিক আন্দোলোনের প্লাটফর্মে। কবিতা বাস্তবতাকে সবসময় সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারলেও, সাধারণত এমন একটি ভাষার দ্যোতনা তৈরি করে যা মানুষকে আলোড়িত করে। একটি শিল্প ফর্ম হিসেবে, সমস্ত শিল্প যা করে, এর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী শিল্পভাষার নামই কবিতা। যেকোন কবিতা তার নিজস্ব যোগ্যতার উপর দাঁড়িয়ে থাকে এবং স্ব-সংজ্ঞায়িত হয়। অন্যদিকে, কবিতা শূন্যতায়ও কাজ করে না। কিছু সাহিত্যিক কৌশল রয়েছে যা কবিকে তাদের মানবতার গভীরতম স্তরে পৌঁছে দেয়। পাঠক তা স্পর্শ করার ক্ষমতা ধারণ করে, তৈরি করে নিজস্ব উপলব্ধি।
কবিতা হতে পারে একটি গভীর অভিজ্ঞতা। এতে পাঠকের গভীরতম অনুভূতি এবং আবেগকে স্পর্শ করার, উদ্দীপিত করার, জাগিয়ে তোলার এবং স্থানান্তরিত করার ক্ষমতা রয়েছে। কবিতা আত্মাকে নাড়া দিতে পারে। প্রতিটি কবিতা পড়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই একই গভীরতার অভিজ্ঞতা থাকবে না, থাকতে পারে না। তবে যখন একটি নির্দিষ্ট কবিতা পাঠকের সাথে তাদের মানবতার গভীরতম স্তরে অনুরণিত হয়, তখন আধ্যাত্মিক কিছু ঘটে এবং একটি গভীর অভিজ্ঞতা ঘটে। পাঠকের মন ও হৃদয়, সচেতন এবং অচেতন উভয় উপায়ে উন্মুক্ত হয়। কবিতাটি তখন আত্মার চোখ দিয়ে দেখা যায়। একই কবিতা যা একজন পাঠক দ্বারা লালিত, পড়া এবং পুনরায় পাঠযোগ্য হয়Ñ তা অন্য একজনকে মোটেও অনুরণিত বা নাড়া নাও দিতে পারে। কবিতা এমনই।
এছাড়া, কিছু কবিতার পঙক্তিমালা কিছু ব্যক্তিকে তাদের গভীরতায় এমনভাবে স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে যা গদ্যের শব্দগুলো সহজভাবে পারে না। এর কারণ হচ্ছে, কবিতাটি এমন একটি ভাষায় লেখা যা যুক্তি, চিন্তা ও যুক্তির চেয়েও বেশি বোঝায়। জীবনের অভিজ্ঞতার ভাষায় গভীর থেকে গভীরে কথা বলার জন্য শব্দের বৃত্ত ভেঙে ফেলে। আর তা কবিতাকে একটি জ্ঞানের ভাষা করে তোলে। কবিতায় এমন শব্দের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলার একটি উপায় রয়েছে, যা আগে অবর্ণনীয় ছিল। যখন একজনকে মানবতার গভীরতম স্তরে একটি কবিতা দ্বারা আন্দোলিত করা হয়, তখন উত্তরণটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাঠক কবিতার শব্দগুলোর একটি বিন্দু থেকে বহুবিন্দুর দেখা পায়। গভীরতা এবং নীরবতার একটি আপন আয়না নির্মাণ করে। অনুভূতি ও আবেগ তখন মূলত বাস্তবতার পথেই পা বাড়ায়। এখানে এই কবিতাটি আমরা পাঠ করতে পারিÑ
‘লেখাগুলো অতি শান্ত, যাবতীয় ক্রিয়াকর্মশেষে
জেগে ওঠে, ডুবে যায়, এই মৃত দেশে
অগ্নিদগ্ধ উন্মাদিনী যেন ঐশী খুঁজে
মহাশূন্যে উড়ে যায়, শুধু চক্ষু বুজে
আমি তার অতি ভক্ত, গৃহ থাকে চাঁদে
ধানসিঁড়ি পড়ে আছে ভবচক্রফাঁদে’।
[ সিঁড়ি/ জহর সেন মজুমদার ]
কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যে প্লটগুলো বেশি ব্যবহৃত হয় তা হলো ইমেজ ও সিম্বলিজম। চিত্রকল্প ও প্রতীক। কেউ চাইলে কবিতাকে প্রতীক দিয়ে শুরু না করে ছবি দিয়ে শুরু করতে পারেন। যেভাবেই হোক, একটি কবিতা যখন মানুষকে ভাবাতে পারে, সেটাই হতে পারে পৃথিবীর সকল মানুষের আস্থার জায়গা। হাঁ, তা একসময় অনূদিত হতে পারে, যেকোনো ভাষায়Ñ এই প্রত্যয় রেখেই একজন কবি বিদায় নেন এই পরিভ্রমণ শেষে।
তিন.
কবি কবিতার আয়না নির্মাণ করেন নিজেকে দেখার জন্য। সেই আয়না একসময় বিস্তৃত হয়। কবিতার আভা ছড়িয়ে পড়ে দেশে দেশে, মানুষে মানুষে। কবি নাজিম হিকমতের কবিটার দিকে আমরা তাকাতে পারি। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী কবি নাজিম হিকমত কিন্তু বিপ্লবী ধারার কবি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। রোমান্টিক কমিউনিস্ট হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। শিল্পের জন্য, শিল্প বা কবিতার জন্য কবিতা নয়; বরং ‘মানুষের জন্য সবকিছু’ এই কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিলেন নাজিম হিকমত ছেলেবেলা থেকেই।
ছেলেবেলা থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতেন একদিন মানুষের মুক্তি হবে। স্বপ্ন দেখতেন, দরিদ্র ও নি¤œবর্গের মানুষ একদিন রাষ্ট্রে তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। স্বপ্ন থেকেই শুরু হয় সংগ্রাম। খুব অল্প বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নেই। বুঝেছিলেন, বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই পূর্ণ হতে পারে তাঁর সেই স্বপ্ন। যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী কর্মকান্ডে। লেখালেখি শুরু করেছিলেন বিপ্লবী ধারার পত্রিকায়। কিন্তু জন্মভূমি তুরস্কে তখন চলছে চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের শাসন। যেকোনো বামপন্থী কার্যক্রম কঠোর হাতে দমন করা হচ্ছিল। ১৯২৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বন্দী হলেন প্রথমবার। কিন্তু স্বৈরশাসক বেশি দিন রাখতে পারেননি তাঁকে জেলে। তাঁর মুক্তির জন্য বিবৃতি দিয়েছিলেন, মিছিল করেছিলেন পাবলো নেরুদা, জ্যঁ পল সার্ত্র ও আরও অনেক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল। মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। মুক্তি পেয়েই নাজিম সোজা চলে গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। দীক্ষা নেন মার্ক্সীয় রাজনীতির। সান্নিধ্য পান কালজয়ী রুশ কবি মায়াকোভস্কির। লিখেন একের পর এক কবিতা। ছাপা হতে থাকে একের পর এক বই। যে বই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বহু ভাষায় অনূদিত হয়। দেশে দেশে বিপ্লবের প্রেরণা হয়ে ওঠে নাজিমের কবিতা। এই প্রেরণা সকল মানুষের বুকের ভেতর ঢেউ তোলে।
পড়–ন নাজিম হিকমতের কবিতাÑ
নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা
আমি তোমর দিকে তাকিয়ে।
মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি প্রিয়তমা।
রাত্রির অন্ধকারে, গ্রামদেশে শুকনো পাতায়
আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, তোমাকে স্পর্শ করছি।
আমি আছি মানুষের মাঝখানে,
ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে
মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।
[জেলখানার চিঠি]
নাজিম হিকমতের কবিতায় দেশপ্রেম ও ব্যক্তিপ্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যেন প্রেমিকের ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের যুগলবন্দী। নাজিমের কবিতা মানুষের, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির কথা বলে। প্রেমিকার জন্য কবির যে ভালোবাসা, তাঁর গভীরে থাকে মাটি ও মানুষ। এখনও বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ মজলুম। আর এই মজলুমের পাঁজরে যে শব্দের ঢেউ দোল খেয়ে যায়, সেটাই প্রকৃত কবিতার ক্যানভাস। যাদের তাকাবার সাহস আছে, তারা তাকাতে পারে সেই ক্যানভাসের দিকে। বাকীরা চোখ মুদে থাকে।