রথযাত্রা উৎসব
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জুন ২০২৩, ৩:১৬:৩১ অপরাহ্ন

প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথি সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা মহোৎসব হিসেবে পালিত হয়। নয়দিন ব্যাপি চলা এ উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার মধ্য দিয়ে। স্নানযাত্রা উৎসবের পনের দিন পর অনুষ্টিত হয় রথযাত্রা। স্নানযাত্রার পর পনেরদিন ভগবান শ্রীজগন্নাথের বিগ্রহ ভক্ত সাধারণকে দর্শন করানো হয় না। কারণ স্নানের পর বিগ্রহগণের ঠান্ডা লাগে অর্থাৎ জ্বর আসে। এসময়কে বলা হয় অনবসর কাল। এসময় ভক্ত ভগবানকে পাচন ভোগ নিবেদন করেন। মূলত ভগবান ভক্তদের থেকে দূরে থেকে ভক্তদের বিরহ অনুধাবণ করার জন্যই এই লীলাটি করে থাকেন। অতঃপর অনবসর কাল অতিক্রম হওয়ার পরে অর্থাৎ রথযাত্রার আগের দিন জগন্নাথ, বলদেব, সুভদ্রা মহারাণী পুনরায় তাঁদের ভক্তদের দর্শন দান করেন। এই দিনটি নব যৌবন দর্শন নামে পরিচিত।
নয়দিন ব্যাপি চলা রথযাত্রা মহোৎসবের প্রধান উৎসবসমূহ হচ্ছে পা-ু বিজয়, ছেরা পঁহরা এবং হেরা পঞ্চমী অন্যতম। ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের সিংহাসন ছেড়ে রথে আরোহন করাকে পা-ু বিজয় বলে। পা-ু বিজয় সম্পর্কে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী চৈতন্যচরিতামৃতে বর্ণনা করেছেন, পা-ু বিজয় দেখিবারে করিল গমন/জগন্নাথ যাত্রা কৈল ছাড়ি সিংহাসন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর ভক্তদের নিয়ে শ্রীজগন্নাথদেবের ‘পা-ু-বিজয়’ দর্শন করতে গেলেন। মহারাজ প্রতাপরুদ্র স্বয়ং তাঁর পাত্রদের নিয়ে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর পার্ষদদের পা-ু বিজয় উৎসব দর্শন করালেন। দয়িতাগণ জগন্নাথদেবের বিগ্রহ সিংহাসন থেকে রথে বহন করে নিয়ে যান। বলাবাহুল্য এই দয়িতাশ্রেণি ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহের সেবক। এরা উচ্চ কুলোদ্ভূত নয়, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় কিংবা বৈশ্য ও নয়। এরা ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত। ফলে তারা ভদ্রবণের সন্মান লাভ করেন। এই দয়িতা শ্রেণি ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা থেকে শুরু করে নীলাচল থেকে গুন্ডিচা মন্দিরে গমন এবং পুনরায় নীলাচলে জগন্নাথদেবের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাস ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের সেবাযতœ করে থাকেন।তবে দয়িতাদের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভূত তারা দয়িতা পতি হিসেবে পরিচিত। এরা অনবসরকালে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবকে মিষ্টান্ন ভোগ এবং প্রতিদিন সকালবেলা বাল্যভোগ অর্পণ করেন। রথযাত্রা উৎসবে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের বিজয় বিগ্রহ নিয়ে রাস্তায় শোভাযাত্রা করা হয়ে থাকে।
‘ছেরা পঁহরা’ রথযাত্রা মহোৎসবে অনুষ্টিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্টান। ছেরা ও পঁহরা শব্দে উড়িয়া ভাষায় পঁহরা মানে ঝাড়ু দেওয়া বা মার্জন করা আর ছেরা শব্দটির অর্থ লেই বা চন্দন বাটা। রথযাত্রায় রথ গমনের রাস্তা ঝাড়ু দিতে দেখা যায়। মূলত এটাই পঁহরা নামে পরিচিত। পূর্বাকালে রাজা, মহারাজাগণ রথ গমনের রাস্তা ঝাড়ু দিতেন। রাজা প্রতাপরুদ্রও শ্রীজগন্নাথদেবের রথের যাত্রাপথ ঝাড়ু দিতেন এবং সেই পথে চন্দন জল সিঞ্চন করতেন। রাজা জগন্নাথদেবের এমন সেবা করার পরও ভাবতেন তুচ্ছ সেবা করছেন। রথের পথ ঝাড়ু বা মার্জন করলে চিত্তরূপ দর্পণ মার্জন হয়। বর্তমান রথযাত্রা মহোৎসবেও ছেরা পঁহরা অর্থাৎ রথের পথ ঝাড়ু দিতে দেখা যায়। তবে এখন আর কোন রাজা, মহারাজা কিংবা মহারথীকে ঝাড়ু দিতে দেখা যায় না। বর্তমানে সাধারণ ভক্তরাই রথ গমনের রাস্তা ঝাড়ু দেন এবং ভগবান শ্রী জগন্নাথদেবের বিশেষ কৃপা লাভ করে থাকেন।
‘হেরা পঞ্চমী’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসের শুক্ল ষষ্টী তিথিতে অর্থাৎ রথযাত্রার পঞ্চম দিনে। ‘হেরা পঞ্চমী’ তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব ভ্রাতা বলরাম এবং ভগিনী সুভদ্রা মহারাণী সমেত সুন্দরাচলে মাসির বাড়ী অর্থাৎ গুন্ডিচা মন্দিরে বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন লক্ষ্মীদেবী জগন্নাথ বিরহে তীব্র বিচ্ছেদ অনুভব করছিলেন। লক্ষ্মীদেবী তখন সেই বিরহ বেদনার কথা তাঁর ভগিনী বিমলাদেবীর কাছে ব্যক্ত করেন। বিমলাদেবী উপদেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন তাঁর স্বামী জগন্নাথদেবের সাথে সুন্দরাচলে সাক্ষাৎ করতে যান। সেই অনুসারে লক্ষ্মীদেবী হেরা পঞ্চমীর দিন গুন্ডিচা মন্দির অভিমুখে যাত্রা করেন পতিদেব শ্রীজগন্নাথদেবের দর্শন লাভে। যা হেরা পঞ্চমী বা লক্ষ্মী বিজয় উৎসব নামেও পরিচিত।মহারাজ প্রতাপরূদ্র তখনকার সময়ে মহাড়ম্বরে এই উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।