প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র ও গণতন্ত্র
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জুন ২০২৩, ৩:২৩:১৯ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
একজন সাংবাদিককে সামনে পেয়ে শিশুর মতো ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন বন্যাকবলিত মধ্যবয়সী একজন কৃষক। আমি লোকটির দিকে ভালো করে থাকালাম । এমনিতে শক্তসমর্থ মানুষটি কোমর সমান পানিতে দাঁড়িয়ে কান্না থামাবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছিলেন। স্থানটি সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যাপ্লাবিত একটি গ্রাম।
কাছেই ছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক কর্তৃক বন্যাপ্লাবিত এলাকায় ত্রাণকার্যে নিয়োজিত। তিনি বললেন, বলতে গেলে সিলেট জেলার বেশীরভাগ উপজেলাই বন্যায় প্লাবিত। আমরা জেলা প্রশাসক এর নির্দেশে সাধ্যমতো সার্বিক সাহায্যের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাছে যতটুকু ত্রাণসামগ্রী ছিল সবই বিতরণ করা হয়েছে। আরো ত্রাণ আসছে, আমরা দিতেই আছি। ক্ষয়-ক্ষতির খোঁজখবরও নেওয়া হচ্ছে নিবিড়ভাবে। ক্ষতিগ্রস্ত সকলেই সরকারি সহায়তা পাবে। কেউ বাদ যাবে না। ইতোমধ্যে পানি ভেঙে চারপাশ থেকে ছুটে আসে বন্যাদুর্গত আরো মানুষ। তাদের ঘর-বাড়ি গরু, ছাগল সব ডুবে গেছে। তারা সমস্বরে নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে লাগল। অনেকেরই ক্ষেতের ফসল ভেসে গেছে। ঘরে খাবার নেই। ছেলে-মেয়েরা কান্নাকাটি করছে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, দুর্যোগ তাদের পিছু ছাড়ছে না। অতি বর্ষণজনিত বন্যার ফলে একেবারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। বন্যাপীড়িত এলাকা পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসক সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশারকালে তৎপর বলেই মনে হলো।
বিপন্ন এই মানুষগুলোকে দেখে অন্য অনেকের মতো আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। আমি বিচলিত হই। তবে আমি নিশ্চিত যে, সবাই সরকারকে দোষারোপ করবে। এটাই স্বাভাবিক। দুর্যোগ ও দারিদ্র্যকবলিত দেশে যারা সরকারের দায়িত্বে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে মানুষের অন্তহীন ক্ষোভ ও অভিযোগ নতুন নয়। এর জোড়ালো ভিত্তিও হয়তো আছে। তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়। আমার ধারণা, সরকারের উপর ক্ষোভ ও অসন্তোষের সবচেয়ে বড়ো কারণটি হল জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। এমনিতে তারা অল্পেই তুষ্ট। কিন্তু দুর্যোগকালে সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। তারা চান, যেখানে যা কিছু ঘটুক সরকার তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। সাহায্য-সহযোগিতা করবে। হতদরিদ্র মানুষকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। উপর্যুপরি দুর্যোগজনিত পর্বত প্রমাণ অসহায়তা ও চরম দারিদ্র্যই তাদের মধ্যে এ ধরনের হতাশার জন্ম দিয়েছে। বিপদে-আপদে সরকার ছাড়া আর কারো কাছে যাওয়ারও তো উপায় নেই। এ অসহায়তা শুধু যে জনগণের তাও নয়, দরিদ্র দেশগুলোতে সরকারের অসহায়তাও কোনো অংশে কম নয়। তবে আমি বলব বর্তমান সরকার ও প্রশাসন বন্যাপ্লাবিত মানুষদের সহায়তা প্রদানের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, তৃতীয় বিশ্বের অপরিণামদর্শী কিছু রাজনৈতিক নেতা প্রায়শ বাস্তবতা বিস্মৃত হয়ে নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী হানাহানিতে লিপ্ত হন। এতে দুর্যোগে ও দারিদ্র্যে বিপন্ন মানুষগুলোর দুর্ভোগই শুধু বৃদ্ধি পায় না, একই সঙ্গে কখনও কখনও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসনের অভাবে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের পথও রুদ্ধ হয়ে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য।
দারিদ্র্য ও দুর্যোগজনিত অসহায়তার ছবি নতুন বা আকস্মিক নয়। শত শত বছর ধরে এমনি চলে আসছে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও তার অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা ধনে, ধানে ও মানে সমৃদ্ধ হলেও দারিদ্র্য ও দুর্যোগজনিত অসহায়তার সেই চিত্র খুব একটা পাল্টায়নি। এখনও অর্ধেকেরও বেশি মানুষের বসবাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। এখনও কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা প্রকৃতির কৃপার উপর নির্ভরশীল। দুর্যোগ সাধারণ মানুষের চিরাচরিত অসহায়তার চিত্রটি যে তেমন বদলায়নি তা বোঝার জন্য খুব বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি পানিতে তছনছ হয়ে গেছে সিলেট জেলাসহ সারাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা। বাঁধ ভেঙে তাদের ক্ষেতের ফসল ভেসে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে ঘরবাড়ি। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে বহু পরিবার। সৃষ্টি হয় অভাবনীয় মানবিক বিপর্যয়ের। সর্বত্রই সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে যেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। দাঁড়াতে হচ্ছে বিপন্ন মানুষের পাশে। এটা ভালো লক্ষণ।
শত শত মানুষ প্রশাসন প্রদত্ত আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তাদের ঘর-বাড়ি, ফসলের জমি সবই ডুবে আছে বন্যার পানিতে। কাজ নেই, খাদ্য নেই। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। বিশুদ্ধ পানির জন্যও তাদের পাড়ি দিতে হচ্ছে দীর্ঘপথ। সরকারি সহায়তাই এখন তাদের একমাত্র ভরসা। বর্ষা এসে গেছে। অথচ বহু স্থানে বাঁধ মেরামতের জরুরি কাজটিও শেষ করা সম্ভব হয়নি। ফলে মানুষের দুর্ভোগ শুধু দীর্ঘায়িত হবে না, তা আরো চরম আকার ধারণ করবে। সরকারি সহায়তা ছাড়া বন্যাদুর্গত মানুষগুলোর বাঁচার উপায় নেই বললেই চলে। সিলেটের জেলা প্রশাসক জনাব এম কাজী এমদাদুল ইসলাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরী সভা আহ্বান করেন। একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে আমিও সেই সভাতে উপস্থিত ছিলাম। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জেলার সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ। উক্ত সভায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা ও পরবর্তী কার্যক্রম সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হয়। সভার সভাপতি জেলা প্রশাসক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের, সকল মহলের সহযোগীতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের আহ্বান জানান। তিনি বলেন সরকার তৎপর, সজাগ ও সচেতন। সরকার থেকে প্রাপ্ত সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং নগদ টাকা বন্যাকবলিত মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে সরকার কী করবে? ক’জনের পাশে দাঁড়াবে? সরকারের সামর্থ্যরেও তো একটা সীমা আছে। শুধু তাই নয়, দরিদ্র ও দুর্গত মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে যদি সরকারকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, তাহলে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও উন্নয়নের বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি কাজগুলো সরকার কখন করবে? কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকারও উপায় নেই। কারণ প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত নানা দুর্যোগ তো লেগেই আছে। এখানে সুস্থির হয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশই বা কোথায়?
সরকারের এ অসহায়তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে নীতি-আদর্শ ও দেশপ্রেম বিবর্জিত কিছু অসাধু মানুষ। তারা প্রশাসনে যেমন আছে, তেমনি সরকারেও আছে। আছে সর্বত্রই। তারা দেশের কথা ভাবেন না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার পরোয়া করেন না। তারা শুধু নিজেদের আখের গোছানোর কথা ভাবেন। ভাগ-বাটোয়ারা ঠিক থাকলেই তারা খুশি। তাদের দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রাই শুধু বাড়ে না, সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন দুর্যোগের। বলা বাহুল্য এ অবস্থা একদিনে হয়নি। এটা দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার ফসল। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র নির্ভরযোগ্য পথ হল গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। সর্ষের মধ্যে ভূত কম-বেশি সবখানেই আছে।
আবহমান কাল থেকে দুর্যোগ ও দারিদ্র্য দেশের অধিকাংশ মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ সবের হাত থেকে সহজে পরিত্রাণ মিলবে বলেও মনে হয় না। টিকে থাকার একমাত্র পথ হল, লড়াই। দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে টিকে থাকলেই চলবে না, দুর্যোগ ও দারিদ্র্যকে পরাজিত করে এগিয়েও যেতে হবে সামনের দিকে। কাজটি কঠিন কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের অন্তর্গত বিপুল শক্তিকে সফলভাবে কাজে লাগাতে হলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। দুর্যোগ ও দারিদ্র্যের মতো মহাপরাক্রান্ত দুই শত্রুকে পরাস্ত করতে হলে বর্তমান দুনিয়ায় গণতন্ত্রের চেয়ে কার্যকর হাতিয়ার যে আর কিছুই হতে পারে না তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।