নীরব ভোটাররাই নির্ণায়ক
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২৩, ৫:০০:০৩ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম :
সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে বিএনপির ভোট কার পক্ষে যাচ্ছে-এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে নানামুখী আলোচনা। আলাপকালে অনেক ভোটার জানিয়েছেন, মূলত ‘নীরব’ ভোটাররাই হবেন জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক। নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির (জাপা) নজরুল ইসলাম বাবুল-উভয়েই দাবি করেছেন তারা লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন। আজ বুধবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিসিক নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করছে।
সিসিকের বিগত দুটি নির্বাচনে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী বিজয়ী হন। ২০১৮ সালের সিসিক নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরী পান ৯২ হাজার ৫৮৮ ভোট । এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ৬ হাজার ১৯৬ ভোটের ব্যবধানে আরিফুলের কাছে পরাজিত হন। কামরানের প্রাপ্ত ভোট ছিল-৮৬ হাজার ৩৯৮ ভোট। একই ভাবে ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত সিসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে ৩৫ হাজার ১৫৭ ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন আরিফ। সে সময় আরিফ পেয়েছিলেন এক লাখ ৭ হাজার ৩৩০ ভোট আর কামরান পেয়েছিলেন ৭২ হাজার ১৭৩ ভোট। ২০২০ সালের ১৫ জুন অতিমারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। কামরানের অনুপস্থিতিতে এবার মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। আর দলীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন থেকে বিরত রয়েছেন বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে আরিফুল চৌধুরী পেয়েছিলেন মোট ভোটের ২৮.৭৭%। সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইনের দাবি, সিলেট নগরীতে বিএনপি পরিবারের প্রায় লক্ষাধিক ভোট রয়েছে। এর বাইরে বিএনপি সদস্যদের পারিবারিক বলয়েরও কিছু ভোট রয়েছে। বিএনপি যেহেতু নির্বাচন বর্জন করছে, সেহেতু দলীয় নেতা-কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে না যাবার নির্দেশনা আগে-ভাগেই প্রদান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, আমরা এ নির্বাচন বর্জন করছি।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বিএনপি ঘরানার কয়েকজন ভোটার জানান, মূলত কাউন্সিলর প্রার্থীর জন্য তাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে হবে। ভোটে গেলে মেয়র প্রার্থীকেও ভোট দিতে হবে। মেয়র পদে তারা কাকে ভোট দেবেন সে ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি জানিয়ে ওই ভোটাররা বলেন, আওয়ামী লীগের বাইরেই মূলত তারা ভোট দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ অবশ্য এও বলেন, নির্বাচনে যে সব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন-ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও পছন্দের।
নগরীর নয়াসড়ক এলাকার একটি বস্তির বাসিন্দা লিপি বেগম জানান, বরাবর তারা নৌকায় ভোট দেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে সিসিকের বর্তমান মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেটের চারদিকে কেবল পানি আর পানি। এ অবস্থায় ভোটাররা কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে সন্দিহান এ বিএনপি নেতা।
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, সিলেট নগরীতে পর পর দুই বার বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এ সিটিতে বিএনপির ‘ভোট ব্যাংক’ রয়েছে জানিয়ে এ বিএনপি নেতা বলেন, এ সিটিতে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মানুষের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় এ সিটিতে দলের ৪৩ কাউন্সিলর প্রার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিলেটের মানুষ ভোটে যাবেন বলে তার মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দল আগেই বিজয় সুনিশ্চিত করে রেখেছে জানিয়ে এ বিএনপি নেতা বলেন, সিটিতে কে নির্বাচিত হলো তা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
সিসিক নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী (বর্তমানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানো) মাওলানা মাহমুদুল হাসান গতরাতে সিলেটের ডাককে জানান, বরিশালের ঘটনার পর তারা আন্দোলনে রয়েছেন। নির্বাচনে ভোট দিতে তাদের কর্মী-সমর্থকরা যাবেন না-ভোটারদেরও ভোট কেন্দ্রে না যাবার আহ্বান তার।
২০১৮ সালের সিসিক নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাইরে জামায়াতের এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ১১ হাজার, ইসলামী আন্দোলনের ডা: মোয়াজ্জেম খান ২,২০৮, সিপিবি-বাসদের আবু জাফর ৯০৯ ভোট পেয়েছেন। এছাড়া, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ও সিলেট মহানগর বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও তার প্রাপ্ত ভোট ছিল-৫৯২।
বৃষ্টির পূর্বাভাস
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো: সজিব হোসাইন জানান, সিলেটে আজ বুধবারও বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ২৩.০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত এবং দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি জানান, সিলেটে গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
বৃষ্টি নিয়ে শঙ্কা আওয়ামী লীগেরও
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গতরাতে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তারা আশাবাদী। তবে, বৃষ্টি নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। এরই মধ্যে অনেক সেন্টারে পানি উঠেছে। এসব সেন্টারের দোতলায় ভোটগ্রহণ করা সম্ভব হলেও বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি আরো বেগতিক হতে পারে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিশাল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন-এ আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানান।
সিমার গবেষণা ও মেয়র প্রার্থী বাবুলের দাবি
‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইলেকশন মেন্যুভারিং আর্কিটেকচার (সিমা)’ নামের ইউরোপভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমে পাঠানো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে, সিলেট সিটিতে মেয়র হিসেবে জয়ী হবেন নৌকার প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থেকে প্রায় একলাখ ভোট বেশি পাবেন। সিমার দাবি তারা ‘ওয়াইজ গভ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ‘সিস্টার কনসার্ন’। এবারই প্রথম তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। দীর্ঘ ৫২ দিন গবেষণার পর তারা সিলেট সিটি নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করেছে বলে দাবি করে।
এদিকে, জাপার মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল দাবি করেন, সিলেট নগরীতে লাঙ্গলের গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ২১ জুন লাখো ভোটের ব্যবধানে লাঙ্গল বিজয়ী হবে বলে তিনি দাবি করেন। ভোটারদের মধ্যে লাঙ্গলের জোয়ার দেখে তার বিজয় ঠেকিয়ে রাখতে নানামুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। এর অংশ হিসেবে সোমবার তাকে শেষ নির্বাচনী জনসভা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি।
মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের সাথে সংশ্লিষ্ট জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক জগলু চৌধুরী বলেন, নির্বাচনী মাঠ তাদের অনুকূলে রয়েছে। সবদিক বিবেচনায় ভোটাররা তাদের প্রার্থীকে ভোট দেবেন বলে আশা এ আওয়ামী লীগ নেতার।
আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ হলে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল জাপা: রাজনৈতিকভাবে সিলেটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সুসংগঠিত থাকলেও এক্ষেত্রে জাপার সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় দলের নেতা-কর্মীরা ছিলেন একাট্টা। তারা বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে অবিরত প্রচারণা চালান। আর এক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল অবস্থানে ছিলেন-জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। তিনি দলের সব নেতা-কর্মীকে মাঠে নামাতে ব্যর্থ হন। কাউন্সিলর পদে প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের এক বা একাধিক প্রার্থী থাকলেও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে জাপা। কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি’র ৪২ জনকে দলথেকে স্থায়ী বহিষ্কার করায় তারাও কিছুটা চাপে। অপরদিকে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা বর্জনের পক্ষে না থাকলেও জামায়াতের কমপক্ষে ২৫ জন কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিএনপি’র বাইরে সিলেট নগরীতে জামায়াত, জমিয়ত ও খেলাফত মজলিসেরও ভোট রয়েছে। জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে এসব দলের ভোটও ভূমিকা রাখবে বলে অনেকেই মনে করছেন।
নাগরিক সমাজের ভাবনা
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এ নির্বাচনে তাদের প্রত্যাশার কোন প্রতিফলন হয়নি। এ কারণে ভোটারদের মধ্যে কোন উৎসাহ উদ্দীপনা নেই। অনেকক্ষেত্রে নির্বাচনের মানদন্ড ফিলাপ হচ্ছে না বলেও তার মন্তব্য।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্যাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, আমরা সবসময় দল বহির্ভূত স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাই। বাংলাদেশের সংবিধানে মূলত অরাজনৈতিক চরিত্রের স্থানীয় সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, বর্তমানে যেটা হচ্ছে-এটা নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা বহির্ভূত। নাগরিক সমাজ সব সময় চায়, একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও চাপবিহীন নির্বাচন। কিন্তু, এবারকার নির্বাচন চাপবিহীন হবে কি হবে না-তা বুধবার বোঝা যাবে। কিন্তু, অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রধান বিরোধী দল কিংবা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির অনুপস্থিতি রয়েছে। ফলে, নির্বাচন অনেকটা উত্তাপবিহীন হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ার সম্ভাবনা কম-এজন্য আমরা মর্মাহত। সিসিকে ইভিএম-এ ভোটগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অংশীজন অর্থাৎ ভোটারদের মতামত গ্রহণ না করেই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। আগামীতে নির্বাচন কমিশন এমন মতামত নেবে মর্মে প্রত্যাশা করেন তিনি। নির্বাচনকে ঘিরে যাতে মানুষের জান-মাল এবং সহায়-সম্পত্তির কোন ক্ষতি না হয়-সেদিকে খেয়াল রাখতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখারও তাগিদ তার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যাতে জনগণের ওপর বাড়াবাড়ি না করে-সে পরামর্শও তার।