তাঁর নাম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০২৩, ১১:৩২:৫৮ অপরাহ্ন
জেবা রশীদ চৌধুরী:
সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছিলেন সিলেটের রতœবিশেষ। মাত্র ৩৩ বৎসর বয়সে তিনি বিধবা হন। প্রত্যেকটি সন্তানকে তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন শক্ত হাতে। তারা সকলেই স্ব স্ব স্থানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। সমাজ সেবার ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা সর্বজনবিদিত। ঝড় তুফান যুদ্ধ ও শান্তিতে তিনি সবসময় মানুষের সেবায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বিপদে আপদে সকলেই ধনী গরীব নির্বিশেষে তার কাছে স্বস্তি সান্ত¡না পেয়েছেন। দেশ ভাগের পর মওলানা সহুল ওসমানীর পরিবার পরিজনসহ আরও অনেক পরিবার তার বাসস্থানে অবস্থান করেন। তাছাড়া রোগে শোকেও অনেকে তার তত্ত্বাবধানে তারই বাসভবনে এসে উঠেছেন। এদের মধ্যে বৃদ্ধবয়সে গজনফর আলী খান আইসিএস এর নাম যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি তরিকতউল্ল্যা আমীনেরও নাম উল্লেখ করা যায়। এরা তাঁর আত্মীয় ছিলেন না। তেমনি পর্দানশীল আত্মীয় স্বজন ও নিজ বাড়ীতে ডাক্তারবদ্যির চিকিৎসার সুযোগের অভাবে তাঁর বাসায় এসে ডাক্তার দেখিয়ে গেছেন। সমাজের অবস্থা তখন অন্যরকম ছিল। কিন্তু তিনি অদমিত ছিলেন এসব ক্ষেত্রে। অসুখে বিসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা থেকে কেউ বঞ্ছিত হোক এটা তার সহ্য হতো না ।
তিনি যে খুব ধনী ছিলেন তা নয়। কিন্তু ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া বা সাংসারিক অসচ্ছলতায় তিনি যথাসাধ্য মানুষকে সাহায্য করতেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঢেউ কিছুটা হলেও সিলেটে এসে লেগেছিল। ব্যাংকার রেবতী মোহন দে ছুরিকাহত হন অফিস যাবার পথে। বেগম রশীদ তাকে নিজগাড়ীতে তুলে এনে নিজ বাড়ীতে তোলেন। গার্লস স্কুলের ননসিলেটী অবিবাহিত টিচার রমলাদেবীকেও তিনি নিরাপত্তার কথা ভেবে নিয়ে এসেছিলেন রশীদ মঞ্জিলে। তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধে ননসিলেটী সিলেটে আটকা পড়া অনেক ডাক্তার, অফিসার, ব্যবসায়ী, তাঁর সাথে সপরিবারে পাড়ি জমান তার সিরাজ নগর চা-বাগানে। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে পলাতক মাস্টার দাও তার আশ্রয়ে আত্মগোপন করে থাকেন মাসাধিক কাল রশীদ মঞ্জিলে।
তাঁর কাছে মানুষই ছিল মানুষের পরিচয়। কে হিন্দু কে মুসলমান কেবা পুরুষ কে মেয়ে এসবের আগে মানুষ হিসাবেই তার মূখ্য পরিচয়- এ শিক্ষাই তিনি তাঁর সন্তানদের দিয়ে গেছেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। নিজ সন্তান ছাড়াও তিনি, সে যুগে আত্মীয় অনাত্মীয় সবাইকে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে পিছপা হতেন না। তাঁর বাসায় তার জীবদ্দশায় অনেক আত্মীয়, অনাত্মীয় লেখাপড়া করে ডিগ্রী লাভ করেছেন, ডাক্তারও হয়েছেন।
নারী শিক্ষায় তিনি অগ্রণী ও সক্রীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। ৪০ এর দশকে তিনি ও তাঁর স্বামী আব্দুর রশীদ সাহেব মুসলমান মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন উপলব্ধি করেন এবং তাদের প্রচেষ্ঠায় জালালাবাদ মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাড়ী বাড়ী ঘুরে মেয়ে যোগাড় করেন বেগম রশীদ। গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে তাঁর এক মেয়ে সহ মাত্র ছয়সাতজন মুসলমান মেয়ে তখন অধ্যয়নরত ছিল।
দেশ ভাগের পর সিলেট মহিলা কলেজ, সম্ভবত ছাত্রী সংখ্যা কমে যাবার কারণেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। দূরদর্শী এই মহিলা কলেজ বন্ধ হতে দেননি। বেসরকারীভাবে হলেও কলেজটি একটানা চালু রাখা হয় বেগম রশীদ এর একান্ত প্রচেষ্টায়। তাঁর সাথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কালী ঘাটের বেগম জহিরুন্নেছা ও রানা ফাত্তা খানম। সে সময়ে যখন মুসলিম মহিলাদের রাস্তায় কদাচিৎও দেখা যায়নি – তখন রক্ষণশীল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই মহিলা সহকর্মীদের নিয়ে মহাজন পট্টির ব্যবসায়ীদের কাছে গিয়ে চাঁদা তুলেছেন এবং নারী শিক্ষায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। টাকার প্রয়োজন ছিল। কারণ এম.সি. কলেজের প্রফেসর লেকচারারদের অনুরোধ করে পার্টটাইম পড়ানোর কাজটা তাদের দিয়েই করানো হচ্ছিল। অবসরপ্রাপ্ত গিরীন বাবু বেগম রশীদের অনুরোধে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সিলেট মহিলা কলেজের। হাতে গোনা ক’টি মেয়ে নিয়ে চলতে থাকে কলেজটি এবং সময়োপযোগী এ পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে পরবর্তীতে কলেজটি আবার সরকারী গ্রান্ট পায়।
দুর্গাপাশা গ্রামে তার স্বামী আব্দুর রশীদ চৌধুরী নিজ নামে হাইস্কুল চালু করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আমৃত্যু বেগম রশীদ ঐ স্কুলের সার্বিক উন্নতির সাথে নিজেকে লিপ্ত রাখেন।
যুগের তাগিদে ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজন উপলব্ধী করে তিনি পুত্র আমীনুর রশীদ চৌধুরীর সাথে হাত মিলান ব্লু বার্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠায়। তাঁর দুই নাতী যিয়া মুরসালীন ও নুরুর রশীদ হেরল্ড এ স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র।
নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া নারী উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করতেন। ক্ষমতায়নে নারীর অর্থনৈতিক প্লাটফর্ম প্রয়োজন। তাই রোজগারের ব্যবস্থাকল্পে মেয়েদের ১৯৫০/১৯৬০ এর দশকে তিনি কার্যক্রম গ্রহণ করেন নিজ প্রচেষ্টায়। আঞ্জুমনে বেহবুদি এ নিসওয়ান, সিলেট মহিলা সমাজ কল্যাণ সমিতি ও সিলেট মহিলা কুটির শিল্প সমিতির মাধ্যমে একাজে মেয়েদের/মহিলাদের সঙ্গবদ্ধ করা হয়। সমাজ কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে বয়স্ক শিক্ষা, সেলাই এমব্রয়ডারী শেখানো হতো আম্বরখানা স্কুলে এবং কাটিং সহ সেলাই ও এমব্রয়ডারী, সর্বপ্রকার ষ্টিচ সমূহের বিশেষ সার্টিফিকেট কোর্সও সেখানে চালু হয়। রীতিমত প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর পরীক্ষা নিয়ে সার্টিফিকেট দেওয়া হতো।
মহিলা কুটির শিল্পেই কেউ চাকুরী পেতেন নয়তো সেলাই ফোড়াই করে মহিলারা রুজী রোজগার করতে শুরু করেন। কাজকর্ম বেগম রশীদের বাসভবনে রশীদ মঞ্জিলে হতো। চৌহাট্টায় বুটিক ছিল (সম্ভবতঃ দেশের সর্বপ্রথম মহিলাদের পরিচালিত বুটিক এটি) তাছাড়া ঢাকা চট্টগ্রামেও শাড়ী পেটিকোট ও তৈরী পোষাক বিক্রি হতো। এতে অনেক স্বল্প বয়সী বিধবা ও অবিবাহিতা মেয়েরা কাজ করে নিজেই রুজী রোজগার করতে সমর্থ ও স্বাবলম্বী হয়েছেন।
এছাড়া পাড়ার ছেলে-মেয়েদের নামাজ ও কোরআন শিক্ষা দেওয়া হতো আম্বরখানা স্কুলে, ভোরে ক্লাস শুরু হবার আগে। তাছাড়া ছেলে-মেয়ে ও বয়স্কদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও প্রত্যেক দিন ভোরে একই স্থান থেকে দেওয়া হতো। এসবেরই হোথা ছিলেন তিনি। তিনিই ঔষধ-পত্র, চিকিৎসক এবং শিক্ষকের মাইনে যোগাতেন নিজে আম্বরখানা স্কুলের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, কিন্তু এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আজীবন।
ব্যক্তিমালিকানায় ৩টি চা বাগান তিনি পরিচালনা করেছেন ৩৩বছর বয়স থেকে একটানা ৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত। তখনকার দিনে নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন চা বাগান। স্বীয় পুত্র আমীনূর রশীদ চৌধুরীকে নিয়ে তিনি ন্যাশনাল টি এসোসিয়েশন চালু করেন। পরবর্তীতে এটাকে মার্জ করতে হয় পাকিস্তান টি এসোসিয়েশনের সাথে যা স্বাধীনতা উত্তর কালে বাংলাদেশীয় চা সংসদ নামে অবিহিত হয়।
ব্যক্তিমালিকানায় এদেশের প্রথম রাবার বাগান তারই প্রতিষ্ঠিত। তেমনি সিলেটের প্রথম কোল্ডস্টোরেজও তারই শ্রমের ফল।
স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করা ছাড়াও এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সম্পত্তি তিনি রেখে যান তার ছেলে মেয়েদের জন্য। ১৯৪৪ সালে যখন তাঁর স্বামী মারা যান, তখন সহায় বলতে বাপ ভাই তার কেউই ছিলেন না। তাঁর বয়স ছিল তখন ৩৩ বছর মাত্র। তার স্কুল কলেজের কোন বিদ্যাও ছিল না। লেখাপড়া তিনি ঘরেই করেছেন। দেশ বিদেশের সাহিত্যের সাথে তার পরিচয় অনুবাদের মাধ্যমে। স্বামীর সাথে সারা ভারত তাকে ঘুরতে হয়েছে স্বামীর রাজনীতির কারণে। পরে অবশ্য ১৯৫৫ সালে মিডল ঈস্ট এবং ইউরোপ তিনি সফর করেন।
মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি ভারত বিভাগে সোচ্চার ও সক্রীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালের রেফারেন্ডামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি সিলেটের মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেমব্লির সদস্য নির্বাচিত হন। সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তিনি সর্বদা সোচ্চার ও সচেষ্ট ছিলেন। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান তাতে রাজীও হয়েছিলেন। কিন্তু তা ছিল শর্ত সাপেক্ষে। সেকেন্ড এমেন্ডমেন্ট বিলে তাদের পক্ষে ভোট দিতে হতো এর জন্য। কিন্তু তিনি সে শর্ত মানতে রাজী হননি। সে সময় তার দুই ছেলে ফরেন সার্ভিসে কার্য্যরত ছিলেন। তাদের চাকুরীর ক্ষতি হতে পারে বলে তাকে হুমকীও দেওয়া হয়েছিল- কিন্তু তিনি তাতেও বিচলিত হননি। তাঁর সুযোগ্য পুত্র হুমায়ুন রশীদের প্রচেষ্টায় সিলেটে ইউনির্ভাসিটি হয়েছে।
পরবর্তীকালে মৌলভীবাজার আসন থেকে তিনি স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।
৩৩ বৎসর বয়স থেকে তিনি সিলেটের মত মফস্বল শহরে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করে গেছেন এবং সেই সাথে শিল্প, রাজনীতি, সমাজ সেবায় বিশিষ্ট অবদান রেখে গেছেন। সেই যুগে এরকম মহিলা বোধহয় দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া দুস্কর। সাদা ফুলহাতা ব্লাউস ও মাথায় কাপড় দেওয়া এই মহিমান্বিত মহিলা সিলেটের গৌরব নিঃসন্দেহে। সিলেটের ইতিহাস তাঁকে বাদ দিয়ে লেখা যায় না।
তিনি ১৯৭৪ সালে ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আসলেই এই মহিলা সিলেটের রতœ তো বটেই, তাঁর অবদান সিলেটের সমাজে বেগম রোকেয়ার অবদানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
লেখক : সিরাজুন্নেসা চৌধুরীর মেয়ে, সাবেক কমিশনার, জাতীয় গার্লস গাইড।