সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০২৩, ৯:০১:৩৬ অপরাহ্ন
মো. আব্দুশ শহীদ নেগালী
ইহরাম বাঁধার মধ্য দিয়ে হজ্জের কার্যক্রম শুরু হয় এবং তাওয়াফে বিদার মাধ্যমে হজ্জের কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটে। এ দুয়ের মধ্যখানে যে সকল অনুষ্ঠানাদি পালন করতে হয় তা সব মিলিয়ে হজ্জের পূর্ণতা আসে। হজ্জের প্রত্যেকটি কার্যক্রমের বা অনুষ্ঠানাদির স্বতন্ত্র ফযিলত রয়েছে। হজ্জ সম্পর্কে রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন, হজ্জ ও উমরার যাত্রী হল আল্লাহর দাওয়াতী মেহমান। সুতরাং তারা যদি তাদের আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন। তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন। (ইবনে মাজাহ)
ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা হজ্জ করতে চায় না তাদের সম্পর্কে রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন, যাকে তীব্র অভাব, অত্যাচারী শাসক, কিংবা গুরুতর রোগ হজ্জ পালন করা থেকে বাধা দেয় নাই। এ অবস্থায় যদি সে হজ্জ না করে মৃত্যু পথে যাত্রা করে, তাহলে সে ইহুদী হয়ে বা নাসারা হয়ে মৃত্যুবরণ করুক। (দারেমী)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমরা একবার হুযুরে পাক (সা.) এর খেদমতে উপবিষ্ট ছিলাম, এমন সময় ইয়ামন হইতে একদল এসে হুযুরে পাক (সা.) কে জিজ্ঞাস করল ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) আপনার জন্য আমাদের মাতা-পিতার জীবন উৎসর্গ হউক। হজ্জের ফযিলত সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করুন।
জিজ্ঞাসার জবাবে রাসূলে করীম (সা.) বললেন, যদি কোন ব্যক্তি হজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে গৃহ হতে বের হয় তাহলে তার প্রত্যেক পদক্ষেপের সাথে সাথেই ঝড়ের বেগে বৃক্ষ হতে শুকনা পাতা পতিত হওয়ার মত তার পাপরাশি ঝরে পড়ে। অতঃপর মদীনায় এসে আমাকে সালাম করে মুসাফাহা করলে, ফিরিস্তাগণও তাদের সাথে অনুরূপ করেন। মিকাতে এসে এহরামের নিয়তে গুসল করলে তার সম্পূর্ণ পাপরাশি ধুয়ে পরিষ্কার করে দেন। নতুন কাপড় পরিধান করলে আল্লাহ পাক তাকে নতুনভাবে পুণ্য দান করেন। লাব্বায়েক বাক্য উচ্চারণ করিলে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি তোমার কথা শুনতেছি। তোমার প্রতি আমার দৃষ্টি আছে।
তাওয়াফের ফযীলত:
ইবনে আবি মালিকায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হুযুরে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেহ কা’বা গৃহের উপর একশত বিশটি রহমত নাযীল করেন। তাওয়াফকারিগণ ষাটটি, কা’বার আশে পাশে অবস্থানকারীগণ চল্লিশটি, এবং কা’বার দিকে দৃষ্টিপাত কারিগণ বিশটি রহমতের ভাগী হন। (গুনিয়াতুত্বালিবীন)
অন্য হাদীসের মধ্যে রাসূলে করীম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ শরীফ সাত পাক তাওয়াফ করেছে এবং তাতে নি¤œ বর্ণিত দোয়াটি পাঠ ছাড়া কোন কথা বার্তা বলে নাই। তার দশটি গোনাহ মুছিয়া দেওয়া হবে। দশটি নেকি লিখিয়া দেওয়া হবে এবং দশটি মর্যাদার ধাপ বৃদ্ধি করে দেওয়া হবে।
দোয়াটি হল, সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালাইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়াহাওলা ওলাক্বুওয়াতা ইল্লাহবিল্লাহ। (ইবনে মাজাহ)
লাব্বায়েকের ফযিলত:
হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন হুযুরে আকরাম (সা.) বলেছেন হজ্জে লাব্বায়েক পাঠ করনে ওয়ালা ব্যক্তিবর্গ কিয়ামতের দিন লাব্বায়েক পাঠ করতে করতে কবর থেকে হাশরের দিকে রওয়ানা দিবে। (গুনিয়াতুত্বালিবীন)
হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়ার ফযিলত:
হাজরে আসওয়াদে চুমু খেলে হাজীগণের গুনাহ সমূহ চুষে নেয়, এ সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) জান্নাত হতে অবতীর্ণ হয়েছে। তখন উহা দুধের চেয়েও সাদা ছিল। পরে আদম সন্তানের গুনাহ উহাকে কালো করেছে (তিরমিযী) গুনিয়াতুত্বালিবীন কিতাবে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ রয়েছে হযরত আলী (রা.) বলেন হযরত আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাঁর বংশধর সৃষ্টি করে আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞাস করলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলেন হ্যাঁ তুমি আমাদের পালন কর্তা। তখন আল্লাহ পাক ‘হাজরে আসওয়াদে’ ঐ স্বীকারোক্তি আমানত রাখলেন ক্বিয়ামতের দিন সম্মানিত হাজীগণের পক্ষে ঐ পাথর স্বাক্ষ্য প্রদান করবে। হাদীসটি সুরা আরাফের ১৭২নং আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ।
মাক্কামে ইব্রাহীম:
মহান রাব্বে কারীম পবিত্র কালামে পাকে ঘোষণা করেন, তোমরা ইব্রাহীমের দাড়ানোর স্থানকে নামাযের জায়গা হিসেবে গ্রহণ কর। (বাক্বারা ১২৫)
প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) এবং আদেশ নিষেধ মান্য করার নামই হচ্ছে ইবাদত। মাক্কামে ইব্রাহীমে দু’রাকাত নামায আদায় করা ওয়াজিব তাতে রয়েছে আল্লাহ ও তাঁর (সা:) এর নির্দেশ।
হাদীস শরীফে রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন যাহা আমি শুনেছি। হাজরে আসওয়াদ ও মাক্বামে ইব্রাহীম বেহেস্তী ইয়াকুত সমূহের মধ্যে দুটি ইয়াকুত। মহান আল্লাহ তায়ালা উহাদের জ্যোতি যদি বিলুপ্ত না করতেন তাহলে পূর্ব পশ্চিম দিগন্তের সবকিছুকে জ্যোতির্ময় করে দিত। (তিরমীযি)
সাফা-মারওয়া সায়ী:
মহান রাব্বুল আলামীন কালামে পাকে ঘোষণা করেন, নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম, (বাকারা ১৫৮) অন্যত্র মহান আল্লাহ পাক বলেন, আল্লাহর নিদর্শন সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে তা হবে তার হৃদয়ে খোদাভীতির প্রমাণস্বরূপ (সূরা হজ্জ ৩২) সাফা মারওয়ায় সায়ী করা ওয়াজিব। হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন, জামরায় কংকর নিক্ষেপ এবং সাফা মারওয়ার মধ্যে সায়ী করা আল্লাহর যিকির প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রবর্তিত হইয়াছে (তিরমিযী) অর্থাৎ সাফা মারওয়ায় সায়ী এবং কংকর নিক্ষেপ এ দুটি হাদীসের আলোকে উত্তম এবাদত এবং যিক্রুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করার সমতুল্য সাওয়াব।
আরফার ময়দানের ফযিলত:
আরফা শব্দের অর্থ চেনা-জানা বা পরিচয় লাভ করা। আরফার ময়দান বিশ্বের কাছে একটি ঐতিহাসিক ময়দান হিসেবে সুপরিচিত। হজ্জের তিনটি ফরয যথাক্রমে (১) ইহরাম বাধা (২) তাওয়াফে যিয়ারত (৩) আরফায় অবস্থান। হাদীছ শরীফের মধ্যে এসেছে হজ্জ মানেই আরফায় অবস্থান। ঐতিহাসিক ঐ প্রান্তরকে আরফা নামে নামকরণের পিছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে হাজী সাহেবগণ এ ময়দানে সমবেত হয়ে ইবাদত ও অনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তাদের পরিচয় পেশ করেন, বলিয়াই এর নাম হয়েছে আরফা।
রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন, শয়তান কোনদিন এত অধিক অপমানিত, এতো বেশি লাঞ্ছিত, এতো বেশি ধিকৃত এবং এতো অধিক ক্ষুব্ধ আর কোনদিন দেখা যায় নাই আরফার দিন অপেক্ষা। সে দেখিতে থাকে আরফার দিন বন্দার উপর আল্লাহর রহমত নাযীল হইতেছে। তাদের বড় বড় গোনাহ সাফ হইতেছে। (মিশকাত)
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যখন আরফার দিন হয় তখন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং হজ্জ আদায়কারীদের ব্যাপারে ফিরিস্তাদের সম্মুখে গর্ব করেন এবং বলেন তোমরা আমার বন্দাদের দিকে তাকাও এলোমেলো কেশে ধূলাবালির বেশে বহু দূর দূরান্ত হতে চিৎকার করতে করতে আমার কাছে হাজিরা দিতেছে। তোমরা সাক্ষী থাক আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। তখন ফিরিস্তাগণ বলেন অমুকতো এতো বড় পাপী অমুক মহিলা ও এতো বড় পাপী; আল্লাহ বলেন, আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। (মিশকাত) আরফার ময়দানে অবস্থান করার পর মানুষ নবজাতকের মত নিষ্পাপ হয়ে যায়।
হযরত হাসান (রা.) বলেন, হজ্জে অবস্থানরত হাজী সাহেবগণের সাথে ফিরিস্তাগণ সাক্ষাত করেন। উঠারোহিগণকে ফিরিস্তারা সালাম করেন। গাধা খচ্চর বা ছওয়ারীর উপর আরোহনকারীগণের সাথে মুসাফাহা করেন। পায়দল যাত্রীদের সাথে আলিঙ্গন করেন। হজ্জে আসা-যাওয়ার অবস্থায় বা কার্যরত অবস্থায় কেহ মারা গেলে তাকে আল্লাহ পাক জান্নাত প্রদান করেন (গুনিয়াত)
মুযদালিফায় অবস্থান:
মুযদালিফায় অবস্থান হচ্ছে ওয়াজিব। কালামে পাকে মুযদালিফা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক বলেন তোমরা মুযদালিফায় (মাশয়ারে হারমে) আল্লাহকে স্মরণ কর তথা আল্লাহর যিকির কর। (বাকারা ১৯৮) রাসূলে করীম (সা.) বলেছেন যে মুযদালিফায় ফযর নামাযে হাযির হবে এবং তার পূর্বে আরফায় অবস্থান করল সে হজ্জকে পূর্ণ করিল।
হজ্জের বেলায় কুরবানির ফযিলত:
মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন এগুলোর গোশত, রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাক্বওয়া (সূরা হজ্জ ৩৭) হজ্জের বেলায় কুরবানি ওয়াজিব।
মাথা মুন্ডন:
মাথা মুন্ডন বা ক্বছব ওয়াজিব।
মাথা মুন্ডন বা ক্বছব করা ওয়াজিব। হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলে করিম (সা.) বিদায় হজ্জে বলেছিলেন হে আল্লাহ তুমি মস্তক মুন্ডনকারীদের প্রতি অনুগ্রহ কর। একজন সাহাবী বললেন ইয়ারাসূলাল্লাহ (সা.) যারা চুল ছাটাইয়াছেন তাদের প্রতিও রাসূল (সা.) দ্বিতীয়বারও রাসূল (সা.) বললেন হে আল্লাহ মাথা মুন্ডনকারীদের প্রতি অনুগ্রহ কর। একজন সাহাবী বললেন হে আল্লাহর রাসূল (সা.) চুল ছাটাইকারিদের প্রতিও। তৃতীয় বার রাসূল (সা.) বললেন হে আল্লাহ চুল ছাটাইকারীদের প্রতিও অনুগ্রহ কর (বোখারী) চুল ছাটাই থেকে মস্তক মুন্ডনে ফযিলত বেশি।
ইবনে হাজার আছকালানী (র.) বলেন মাথা মুন্ডনে একদিকে বন্দেগীর নিদর্শন সেভাবে ফুটে উঠে, তেমনি বিনয়বণতাও ফুটে উঠে। আল্লাহর কাছে নিজেকে দীন হীনভাবে প্রকাশ করা হয় এবং আত্মঅহমিকাও খর্ব হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা সকলকে হারামাইন শরীকাইনের যিয়ারত তথা হজ্জ করার মত তাওফিক দান করুন আমীন।
লেখক : শিক্ষক।