মার্কিন ভিসানীতি এবং বাংলাদেশের সতর্ক অবস্থান
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জুন ২০২৩, ৫:০৫:৪৩ অপরাহ্ন
আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোকটি আমার খুবই আপনজন। প্রায়ই মোবাইলে তার সাথে কথা হয়। একে অন্যের কথা বলতে বলতে শুনতে শুনতে অনেক সময় চলে যায়। হয় অনেক রকম ভাব বিনিময়। দূর দেশে অবস্থান করেও বাংলাদেশের হালচাল ক্যামন তা জানতে চান। চাইবেনই তো। মাটির গন্ধ বলে কথা। চাইলেই কী আর তা ভুলা যায়? যায় না। আর যায় না বলেই খোদ মার্কিন মুল্লুকে বসেও একটু-আধটু বাংলাদেশ নিয়ে ভাবেন। আর দূর প্রবাসে যারা অবস্থান করেন বাংলাদেশের কোন সুখবরে তারা যেটুকুনা আন্দোলিত হন বাংলাদেশের কোন দুঃসংবাদে তারা একটু বেশি বিচলিত হবেন সেটাইতো স্বাভাবিক। নিজের জন্মভূমি বলে কথা!
তিনি গভীর আগ্রহভারে প্রশ্ন করলেন- ‘আমেরিকার নতুন ভিসানীতি নিয়ে আপনারা কি ভাবছেন? আপনারা বা আপনাদের সরকার কি বেকায়দায় পড়ে গেলেন নাকি?’
ভদ্রলোকের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অগত্যা পত্র পত্রিকার সাহায্যই নিতে হলো। ২৬.৫.২০২৩ তারিখের দৈনিক ‘আমাদের সময়’ পত্রিকায় আ’লীগ, জাপা ও বিএনপি এই তিন দলের নেতৃবৃন্দের মন্তব্য হলো- সরকার নতুন ভিসানীতি নিয়ে চিন্তিত নয়- আব্দুর রাজ্জাক, কৃষিমন্ত্রী, ভিসানীতি নিয়ে জাপার আপত্তি নেই- মুজিবুল হক মহাসচিব, জাতীয় পার্টি, ভিসানীতি আ’লীগের জন্য বড় সিগন্যাল- আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি। এই তিন মেরুর নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের মর্মকথা অনুধাবন করা বোধহয় কারো পক্ষে অসম্ভব নয়। মোটামুটি কথা হচ্ছে- মার্কিন এই নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে কি যেন এক অজানা ঝড় তুলেছে। এ ঝড়ের বাতাস কিন্তু সুবাতাস নয়। গরম বাতাস বলেই মনে হয়। আর ঝড় যখন ঘর ভাঙ্গা শুরু করে তখন কারো ঘরের জন্যই তা মঙ্গল বয়ে আনে না। ভাঙ্গনের সুরই কিন্তু ঝড়ের ধর্ম। তাতে চিন্তা-দুশ্চিন্তা বা উল্লাসের কোন মানেই হয় না। একই পত্রিকায় আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু তাদের ভিসানীতি নিয়ে কি মন্তব্য করেছেন তা সংশ্লিষ্ট সবাইকেই গুরুত্বসহকারেই বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘ভিসানীতি সরকার ও বিরোধী দল সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।’
অবশ্য এখানে ভিসানীতি প্রয়োগকারী দেশটি সরকার তথা আ’লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে নিয়েই এ প্রসঙ্গে আলাপ আলোচনা-সংলাপ ইত্যাদি করেছেন। কোন ধর্মীয় বা দ্বিধা বিভক্ত কোন বামদলকে বিবেচনায় এনেছেন বলে পরিলক্ষিত হয়নি। এটাও বোধ হয় আমেরিকার বিবেচনায় এক ধরনের ‘গণতন্ত্র’।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশি সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এর মুখ ফসকে একটা সত্য কথা বের হয়ে এসেছে। যা ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ এর মতোই মনে হয়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত ভিসানীতি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নয়।
এখানে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ তো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি দেশ। বাংলাদেশ তো আমেরিকার কোন ক্ষতি করেনি বা ক্ষতি করার মতো কোন শক্তিও বাংলাদেশের নেই। তাহলে আমেরিকা কেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে যাবে? ‘প্রতিশোধমূলক’ শব্দটির অবতারণা এখানে আসবে কেন। কোন উন্নয়নশীল দেশের কোন নেতা বা দলের স্বাধীনচেতা মনোভাবই কি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মূল কারণ। ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশ নাকি যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্খিত মিত্র। মার্কিনিরা নাকি বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক মিত্র দেশ বলেই মনে করে। হতে পারে তা-ই। কিন্তু ইতিহাস কি বলে? ইতিহাস বলে যে কোন উন্নয়নশীল দেশের শাসক কোন দল বা ব্যক্তি সেটা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোটেই কোন মাথা ব্যথা নেই। তারা এমন দেশের শাসকের স্বাধীনচেতা কোন মনোভাব কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না। আর এই স্বাধীনচেতা মনোভাব যদি কোনভাবে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় তা হলে তো কথাই নেই, প্রতিশোধ তারা নেবেই নেবে। একটু পেছন ফেরে দেখলে চিলি, বাংলাদেশ বা ইরাক কি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়?
১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথাই যদি বলি, তখন ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিলো সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আ’লীগ কি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এর চেয়ে ভালো নির্বাচন কি কখনো আশা করা যায়? সেই নির্বাচনের পরে পাকিস্তানে কি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো আজকের বাইডেন প্রশাসনের তো অজানা থাকার কথা নয়। তখন কি সে সময়ের নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন আয়ূব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কাসহ পাকি প্রশাসনের মন্ত্রী মিনিস্টার আমলা-পুলিশ-সিভিল-আর্মির ব্যক্তিবর্গের আমেরিকান ভিসা প্রাপ্তির ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলো? কোন গণতন্ত্র আর মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি গণতান্ত্রিক মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে আটকে পড়া ৯৩ হাজার বর্বর পাকসেনাদেরকে বাঁচাতে এবং বাংলাদেশকে আঁতুর ঘরে গলাটিপে মারতে তাদের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রেরণ করেছিলো? কারণ তো একটাই এবং সেটা অবশ্যই গণতন্ত্র রক্ষা নয় বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয় বরং আমেরিকার স্বার্থ বজায় রাখা। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনচেতা মনোভাবও তাদের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ। একাত্তরের আমেরিকার গণতন্ত্র আর চীনের সমাজতন্ত্রের করুণ পরিণতিই প্রত্যক্ষ করেছেন বিশ্ববাসী আর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী সাহসী জনগণ। তাইতো বলি, ভিসানীতি সত্যিকার অর্থে কোন দলের জন্যই বড় ‘সিগন্যাল’ নয় বড় ‘সিগন্যাল’ বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং সকল জনগণের। আর এ কারণেই তো আমেরিকার ভিসানীতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট, সাংবাদিক আবুল হোসেন বলেন, ‘সতর্ক থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় নিয়ে’। এক্ষেত্রে শুধু সাংবাদিক ভাইদের সতর্ক থাকলেই চলবে না। সাংবাদিক ভাইয়েরা যাদের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত সতর্কবাণী উচ্চারণ করে থাকেন তাদেরকেই বেশি সতর্ক থাকতে হবে। ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের জন্য সদা সর্বদা সতর্ক থাকলে লাভের লাভ কিছুই, হবে না। সতর্ক থাকতে হবে দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। দেশের আত্মসম্মান, দেশের ভাবমূর্তি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্তের কথা সকলকেই ভাবতে হবে। মার্কিন ভিসানীতি গণমাধ্যমে প্রচার হবার পর দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র একটি দেশের দূতাবাসে যেভাবে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন তাতে মনে হয় দেশে যেন আর কোন দেশের দূতাবাস বা হাইকমিশন অফিস নেই। আর যারা দূতাবাস খুলে বসে আছেন তারা সবাই যেন অপাক্তেয়। একেবারেই গুরুত্বহীন। এমনটি কি কোন স্বাধীন দেশের জনগণের কাছে কাম্য হতে পারে? আর এই সেই জনগণ যারা বা যাদের পূর্ব পুুরুষরা ঐ দেশটির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন। এই সেই জনগণ যাদের পূর্ব পুরুষের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি বাংলার আকাশে বাতাসে এখনো আগের মতোই উচ্চারিত হয়। অতএব ভয়ের তেমন কিছু আছে বলে তো মনে হয় না।
পরিশেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই। এ বক্তব্যটি যদি দেশের অন্য কোন নেতা/নেত্রীর মুখে উচ্চারিত হতো তাহলেও আমি একইভাবে সমর্থন করতাম। সম্প্রতি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা দৃপ্ত কন্ঠে বলেন, ‘আমেরিকা না গেলে কিচ্ছু যায়-আসে না’। তিনি বলেন, ‘কারও মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, বাংলাদেশ নিজের পায়ে চলবে। আমরা নিজের দেশকে গড়ে তুলব। কে আমাদের ভিসা দেবে, না নিষেধাজ্ঞা দেবে- ও নিয়ে মাথা ব্যথা করে লাভ নাই। ৩০ ঘন্টা বিমানে জার্নি করে, আটলান্টিক পার হয়ে ওই আমেরিকায় না গেলে কিচ্ছু আসে যায় না। পৃথিবীতে আরো অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে। সেখানেই আমরা যাতায়াত করব; তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করব। আমাদের অর্থনীতি আরও উন্নত হবে, মজবুত হবে, আরও চাঙ্গা হবে।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সাহসী বক্তব্য অবশ্যই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ কোন বিষয় নয়। বিশ্ব বাস্তবতায় এটা বড়োই কঠিন। এ কঠিনেরে বাস্তব রূপ দিতে পারে একমাত্র দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর বজ্রকঠিন ঐক্য। যে ঐক্য গড়ে উঠেছিলো বঙ্গবন্ধুর ডাকে উনিশ’শ একাত্তরে। দু’হাজার তেইশে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আবারো তেমনি এক ঐক্যের ডাক দিলেন। এ ঐক্যে কোন ধরনের ফাটল কোন অবস্থাতেই কাম্য নয়। অন্তত দেশের বৃহৎ স্বার্থে। জয় বাংলা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।