কোরবানি ও আত্মিক পরিশুদ্ধতা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২৩, ৬:৪৪:২৩ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
কোরবানির মাধ্যমে বান্দা তার রবের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের অনন্য নজির স্থাপন করে। মুসলিম মিল্লাতের ওপর এই কোরবানির আত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক প্রভাব সীমাহীন। খালেস নিয়ত ও আল্লাহভীতি হচ্ছে কোরবানি কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহ পাক বলেন, “আর তাদেরকে আদমের দুই ছেলের সঠিক কাহিনীও শুনিয়ে দাও। তারা দু’জন কোরবানি করলে তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না। সে বললো, আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। সে জবাব দিলো, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকেন।” (সূরা মায়িদা : ২৭) আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, “বলো, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।” (সূরা আল আনআম : ১৬২)
রাসূল (সা) বলেছেন, “কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও।” (ইবনে মাজা, তিরমিজি) কোরবানির উদ্দেশ্য কোরবানির উদ্দেশ্য মূলত পশু কোরবানির আড়ালে মনের পশুত্বকে কোরবানি দেয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া। তিনি তাদেরকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও। (সূরা আল হজ : ৩৭)
মহান আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাদের আত্মিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধতার জন্য বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেগুলোর একনিষ্ঠ আমলের মাধ্যমে বান্দাহ তার স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, শুকরিয়া আদায় ও নৈকট্য লাভ করে থকে। ইব্রাহিমি সুন্নত ‘কোরবানি’ তেমনি একটি এবাদত। বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কিছু চুক্তি ও দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক। বান্দাকে আল্লাহপাক অত্যধিক ভালোবাসেন। বান্দাহ ভুল করলে তিনি ক্ষমা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন। না চাইতেই তিনি বান্দাকে অবারিত দিয়ে থাকেন। তিনি মেহেরবানি করে বান্দাদের জন্য ভালো-মন্দ দু’টি পথ বাতলে দিয়েছেন। তার নির্দেশিত পথে চললে চিরশান্তির জান্নাত এবং না চললে চির দুঃখের জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছেন। অতঃপর তিনি চান বান্দারা যেন তার দেখানো চির শান্তির পথে চলে। বিনা প্রশ্নে এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তার সকল বিধান মেনে চলে। বান্দাগণ শুধু মৌখিকভাবে তাঁর স্বীকৃতি, গুণকীর্তন ও আনুগত্য প্রকাশ করে না-কি বাস্তব কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তাঁর বিধান মেনে চলে তা তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখে নিতে চান। এভাবে বান্দাগণ নিজেদের জীবন, পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসবে তার রবকে। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জীবন-সম্পদ অকাতরে কোরবানি করতে তিলমাত্র পিছপা হবে না। মানুষের অর্থনৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান এমনকি প্রাণের চেয়ে প্রিয় জিনিসটিও তাঁর পথে বিলিয়ে দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হবে না।
কোরবানিও তেমনি একটি বিধান। মনের পশুত্বকে ধ্বংস করে আত্মিক উৎকর্ষতা ও উন্নয়নই যার উদ্দেশ্য। যার কুরআনিক পরিভাষা হচ্ছে ‘তাক্বওয়া’। সূরা আল হজ এর ৩৭ আয়াতে কোরবানির মাধ্যমে ‘তাক্বওয়া’ অর্জনের কথাই বলা হয়েছে। মানুষ খালেস আল্লাহর জন্য এবং নিজের অন্তরের পাশবিকতা দূরীকরণের নিমিত্তে কোরবানি করবে। পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অভাবগ্রস্ত মানুষের জন্য কিছু করণীয়ও নির্দেশ করে কোরবানি। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম বাহন এই কোরবানি। হজরত যায়েদ বিন আরকাম (রা) বলেন, রাসূল (সা) এর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! এই কোরবানি কী? রাসূল (সা) জবাবে বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ) এর সুন্নত বা আদর্শ। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী ফায়েদা রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, (কোরবানির পশুর) প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। সাহাবিরা আবার জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ভেড়া-দুম্বার পশমের ব্যাপারে কী কথা? তিনি বললেন, এর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও এক একটি নেকি রয়েছে।” (ইবনে মাজাহ)
খালেস নিয়ত ছাড়া অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় কোরবানিও কবুল হবে না। আর নিয়তের খুলুসিয়াত আসে তাক্বওয়ার গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ২৭) পবিত্র কালামে পাকের পর পৃথিবীর সবচেয়ে সহিহ্ কিতাব বুখারি শরীফের প্রথম হাদীস- ‘ইন্নামাল আ‘মালু বিন্নিয়্যাহ’। অর্থাৎ আমল বলতেই সহিহ নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমান সময়ে কোরবানির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে।
কোরবানির গোশত খাওয়া ও বন্টন করার মুস্তাহাব হলো- কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া। তবে কেউ যদি পুরোটাই নিজের জন্য রেখে দেয় তবেও কোরবানির কোন ক্ষতি হবে না। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-মিসকিনদের মাঝে দান করতে হয়। তবে, গরিব-নিঃস্বরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দেয়া এবং দান-সাদকা করা অতি উত্তম।
ইসলামের কোরবানি শুধু পশু জবেহর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরের পাশবিকতা-চিন্তা-চেতনার যথাযথ কোরবানি। লোক দেখানো নিয়ত, প্রশংসা কুড়ানো, হাইলাইটেড হওয়া এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে পশু কোরবানি দিলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না হোক না তা যত দামি এবং বড়। মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং পূর্ণ একাগ্রতা নিয়ে কোরবানি করাই হচ্ছে ইবরাহিমি সুন্নাত। আল্লাহ হচ্ছেন ‘আলিমুম বিজাতিছ্ছুদুর’ অন্তর্যামী। সমাজের মানুষ না বুঝলেও তাঁর কাছে ফাঁকি দেয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। তাই আত্মত্যাগ ও মনের সব কুপ্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালানোই হোক কোরবানির একমাত্র উদ্দেশ্য।
লেখক : কলামিস্ট