সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যার শঙ্কা
সিলেটের ডাক প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২৩, ৯:১৪:৫৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত আছে। এতে পানি বাড়ছে দুই জেলার সব নদী ও হাওরে। ফলে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে, বৃষ্টি কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের সবকটি নদনদীর পানি বিপদসীমার নীচে থাকলেও সুনামগঞ্জের প্রায় সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ছাতক পয়েন্টে সুরমার পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দোয়ারাবাজারে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ১০টি গ্রম প্লাবিত হয়েছে। জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের নলজুর নদীর ওপর গুদামের সামনের বিকল্প সেতুটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিরূপ আবহাওয়া ও বন্যার আশঙ্কা থাকায় সুনামগঞ্জে পর্যটক না আসার আহ্বান জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
পাউবো সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সোমবার সিলেটে চলতি বর্ষা মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি বেশি হওয়ায় নদ-নদীর পানিও বেড়েছে। তবে কোথাও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী ৫ দিনের পূর্বাভাসে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এদিকে ভারী বৃষ্টির কারণে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। প্রধান সড়কসহ পাড়ামহল্লায় পানি জমেছে। নগর ঘুরে দেখা গেছে, লামাবাজার, কুয়ারপাড়, চৌকিদেখি, বাদামবাগিচা, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, শিবগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমার কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমেছে। এতে লোকজন চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন।
সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বন্যা নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসন সকল প্রস্তÍুতি গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো, মজিবর রহমান সার্বিক পরিস্থিতি তদারকি করছেন।
দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ৫ দিনের টানা বর্ষণ ও মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দোয়ারাবাজারের সুরমা, চেলা, মরা চেলা, চিলাই, চলতি, কালিউরি, খাসিয়ামারাসহ বিভিন্ন নদীনালার উপচেপড়া পানিতে হাওর, খাল-বিল, মাঠঘাট ভরে গিয়ে সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন লোকজন। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে রোববার সন্ধ্যায় উপজেলার চিলাই নদীর রাবারড্যাম সংলগ্ন ক্যাম্পেরঘাট এলাকার আবুল কালামের বাড়ির পাশে বেড়িবাঁধ ভেঙে বগুলাবাজার ইউনিয়নের ক্যাম্পের ঘাট, আন্দাইরগাঁও, বগুলা, চান্দেরঘাট, সোনাচড়া, নোয়াগাঁও, রামনগর, তেরাকুড়ি ও কান্দাগাঁওসহ দশটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ওই বেড়িবাধ ভেঙে ঢলের তোড়ে ক্যাম্পেরঘাট এলাকার একটি আধাপাকা টিনশেডের ঘর ধসে যায়। এদিকে, সুরমা নদীর উপচেপড়া ঢলের তোড়ে দোয়ারাবাজার-টেংরাটিলা-মহব্বতপুর সড়কের শরিফপুর সাইডিংঘাট এলাকায় রাস্তায় হাঁটু সমান পানির ¯্রােতে যান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রবিশস্যসহ কয়েকশ’ হেক্টর আমনের বীজতলা। হু হু করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে কয়েকটি মাছের পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় শঙ্কিত রয়েছেন শতাধিক মৎস্যচাষি খামার মালিক। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুনামগঞ্জের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার জানান, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টিপাত বন্ধ না হলে অচিরেই জেলার সকল উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। দোয়ারাবাজারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফ মোর্শেদ মিশু জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা, ত্রাণ বিতরণসহ সর্বক্ষেত্রে আমাদের মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে।
ছাতক (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে ছাতকে বন্যার আশংকা দেখা দিয়েছে। পাউবো’র তথ্য মতে, গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ছাতকে সুরমা বিপদ সীমার ১২৪ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া, পাহাড়ী নদী পিয়াইন ও চেলা নদী ও বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ভারী বর্ষণে সুরমা নদীতে বার্জ-কার্গো ও বাল্কহেডে বালু ও পাথর লোডিং-আনলোডিং বন্ধ রয়েছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক।
ছাতকের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনিক প্রস্তÍুতি রয়েছে। প্রয়োজনে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তÍুত রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শান্তিগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, টানা বৃষ্টিপাতে বাড়ছে শান্তিগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি হাওরের পানি। ইতোমধ্যে উপজেলার নিম্নাঞ্চলের অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। কৃষকরা গবাদি পশু ও গোলায় তোলা ধান নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন। কেউ কেউ তুলনামূলক উঁচু ও শুকনো জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন ধান ও গরু-ছাগলকে। উপজেলার আস্তমা, পশ্চিমপাড়া হোসেনপুর, নবীনগর, আক্তাপাড়ার রসূলপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এলাকার অধিকাংশ রাস্তা-ঘাটে পানি উঠতে শুরু করেছে। কোনো রাস্তায় হাঁটুজল, কোনোটায় সবেমাত্র পানি উঠেছে। এসব এলাকায় সাধারণ মানুষজন নৌকা দিয়ে চলাচল করছেন। শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার উজ্জামান বলেন, আমরা সতর্ক ও বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তÍুত আছি। একটি কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, জগন্নাথপুরেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কুশিয়ারা, মাগুরা নদীর পানি বাড়ায় উপজেলার নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উপজেলায় দুটি আশ্রয় কেন্দ্রে ১১টি পরিবার গতকাল সোমবার সকালে আশ্রয় নিয়েছে। তার মধ্যে চিলাউড়া উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে সাত পরিবার ও আবদুস সামাদ আজাদ অডিটোরিয়ামে চার পরিবার রয়েছে।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের নলজুর নদীর ওপর গুদামের সামনের বিকল্প সেতুটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে নলজুর নদীর অপর ঝুঁকিপূর্ণ ডাকবাংলো সেতুর ওপর চাপ বেড়েছে। ভোগান্তি বেড়েছে উপজেলাবাসীর। উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার বিকেলে এক জরুরি সভা ডাকা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিয়াদ বিন ইব্রাহিম ভূঞার সভাপতিত্বে ও এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সোহরাব হোসেনের পরিচালনায় এতে বক্তব্য দেন জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম, পৌরসভার প্যানেল মেয়র সাফরোজ ইসলাম, ট্রাফিক সার্জেন্ট টিপু সুলতান, জগন্নাথপুর বাজার তদারক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহির উদ্দিন, সাংবাদিক অমিত দেব, জুয়েল মিয়া প্রমুখ।
গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ফলে গোয়াইনঘাট উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী সালুটিকর- গোয়াইনঘাট সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। নতুন করে সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়কের দামারী নামক স্থানে অর্ধ কিলোমিটার সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলে বসবাসরত কয়েক হাজার মানুষ রয়েছেন পানিবন্দী।
উপজেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ শাখার কর্মকর্তা (পিআইও) শীর্ষেন্দু পুরকায়স্থ বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। উপজেলা জুড়ে বিপুল সংখ্যক উদ্ধারকারী (রেসকিউ) টিম রয়েছে। আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখছি।